বায়ু দূষণের কুফল সম্পর্কে এখনই সচেতন হোন

বায়ু দূষণের কুফল সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার।

আজকের পৃথিবীতে বায়ু দূষণ এক বিরাট সমস্যা। দূষণের প্রভাবে সারা বিশ্বেই মানুষের স্বাস্থ্যের অপরিমেয় ক্ষতি হচ্ছে। এর কুফল স্বরূপ ব্যাহত হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিও। সাম্প্রতিক কালের কভিড অতিমারি বায়ু দূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে। কভিড গবেষকরা জানাচ্ছেন, যে সব এলাকায় বায়ু দূষণ অত্যধিক সেখানে এই রোগে মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। বায়ু দূষণের কুফল সম্পর্কে এখনই ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।

বায়ু দূষণের মারাত্মক ফলাফল

বর্তমানে সারা বিশ্বেই মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ু দূষণের কুফল পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, আজকের পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৭০০০০০০ মানুষ বায়ু দূষণ জনিত নানান রোগে অকালে মারা যাচ্ছেন [World Health Organization]। শুধু তাই নয়, এধরনের অসুখবিসুখ বেড়ে যাওয়ায় সব দেশেই অসংখ্য কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে, মার খাচ্ছে উৎপাদন। উল্টোদিকে বায়ু দূষণে ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়া মানুষদের চিকিৎসায় বেড়ে যাচ্ছে খরচের বহর।

বায়ু দূষণের সার্বিক ফল বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতি। পরিবেশবাদী সংস্থা গ্রিনপিস জানিয়েছে, বায়ু দূষণের কুফল স্বরূপ সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৫০০০০০০০ (৫০ কোটি) কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে। দৈনিক আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৬০০০০ কোটি টাকা। এটা বিশ্বের সম্মিলিত উৎপাদনের প্রায় ৩.৩ শতাংশ [GreenPeace Report]। বায়ু দূষণের এই ক্ষতিটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।

ক্ষুদ্র কণায় বৃহৎ আশংকা

বায়ুর দূষণকারী পদার্থগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিন্তার কারণ বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কণাগুলো। বিশেষ করে অতিসূক্ষ্ম পিএম ২.৫ (Particulate Matter 2.5 বা PM2.5) কণাগুলো বায়ু দূষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ি। স্বাস্থ্যের ওপর এই কণাগুলোর কুপ্রভাব রীতিমতো ভীতিজনক। এগুলো শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুস অবধি পৌঁছে যায়, সবচেয়ে সূক্ষ্ম কণাগুলো রক্তেও মিশে যেতে পারে। দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে বাস করলে এর কুফল স্বরূপ মানুষের দেখা দিতে পারে নানান বিপজ্জনক রোগ। যেমন,—

  • শ্বাসকষ্ট,
  • ক্রনিক অ্যাজমা,
  • ফুসফুসের নানা সংক্রমণ,
  • হার্টের রোগ,
  • স্নায়ুতন্ত্রের রোগ,
  • ক্যানসার, ইত্যাদি।

বিষাক্ত গ্যাসের বিপদ

সূক্ষ্ম কণাগুলো ছাড়া বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের আধিক্যও কম উদ্বেগজনক নয়। এগুলোর মধ্যে আছে নাইট্রোজেনের একাধিক অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড ও নানান জৈব বাষ্প। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে দূষিত বায়ুর নানা বিষাক্ত গ্যাস মানুষ ও পশুপাখির পক্ষে প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে।

বায়ু দূষণের কুফল: ব্যাধির তান্ডব

যে এলাকার বায়ু দূষণ যতো বেশি, সে এলাকায় শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ হয়ে উঠতে পারে ততো ভয়ংকর। সাম্প্রতিক কালে করোনাভাইরাস ঘটিত কভিড রোগের ক্ষেত্রেও বায়ু দূষণের এই মারাত্মক কুফল স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেছে। আমেরিকার হাভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথ (Harvard TH Chan School of Public Health)-এর গবেষকরা জানিয়েছেন, কভিড সংক্রমণের ক্ষেত্রে ১ ঘনমিটার বাতাসে দূষণকারী কণার মাত্রা প্রতি ১ মাইক্রোগ্রাম বৃদ্ধির সাথেসাথে মৃত্যুর সম্ভবনা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। আমেরিকার প্রায় ৩০০০ এলাকার তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন [The Guardian]।

কভিডে বিপর্যস্ত আর একটি দেশ ইতালির একদল গবেষকও একই ধরণের সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন। তারা দেখিয়েছেন, উত্তর ইতালির যে সব এলাকায় শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে বায়ু দূষণ সবচেয়ে বেশি সেখানে কভিডে মৃত্যুহারও সবচেয়ে বেশি। বায়ু দূষণের কুফল সম্পর্কে ইতালীয় গবেষকদের এই রিপোর্ট ‘এনভায়রনমেন্টাল পলিউশান’ (Environmental Pollution) নামক পত্রিকায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তথ্য দেখলেও একই ধারণায় পৌঁছানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। কারণ অধিক বায়ু দূষণ যুক্ত বড়ো বড়ো শহর ও শিল্পাঞ্চলে কভিড যে ভাবে মৃত্যুর জাল বিছিয়েছে, সে তুলনায় ছোটো ছোটো পরিচ্ছন্ন শহর ও দূষণমুক্ত গ্রাম এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব অনেক কম।

বিপজ্জনক বায়ু দূষণ

বিপজ্জনক বায়ু দূষণে নানান ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে

শ্বাসতন্ত্রের ওপর বায়ু দূষণের প্রভাব

বায়ু দূষণের মারাত্মক ফলস্বরূপ কভিডের মতো রোগে মৃত্যুর সম্ভবনা কীভাবে বেড়ে যাচ্ছে, সেটা বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন। আসলে করোনাভাইরাসের আক্রমণের মূল লক্ষ্যই হলো মানুষের শ্বাসতন্ত্র। দূষণ কবলিত এলাকায় বসবাসকারীদের ফুসফুস সহ শ্বাসতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই থাকে। বাতাসের নানা দূষণকারী পদার্থ ক্রমাগত শ্বাসের সাথে টানতে টানতে আগে থেকেই তাদের শ্বাসতন্ত্রের শ্লেষ্মা ঝিল্লি সহ নিজস্ব প্রতিরোধ শক্তিটা অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই রোগ ছড়াতে শুরু করলে এইসব মানুষদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি হয়। বেড়ে যায় চরম বিপদের আশংকাও।

বায়ু দূষণ থেকে মুক্তির পথ

অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা বায়ু দূষণের কুফল সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে আসছেন। বায়ু দূষণের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি সহ নানান দুষ্প্রভাব থেকে মুক্তি চাইলে কয়লা, পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আমাদের কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি দূষণ রোধী উন্নত প্রযুক্তির প্রচলনও জরুরি। বিলাসিতা ও অপচয়ের কারণে যে সব ক্ষেত্রে ব্যাপক দূষণ ঘটে চলেছে, সেগুলোও বন্ধ হওয়া দরকার।

তবে বায়ু দূষণের কুফল থেকে বাঁচতে চাইলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সবুজায়ন। দূষণমুক্ত সুস্থ পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে সবুজায়নের কোনো বিকল্প আগেও ছিলো না, আজও নেই, আর ভবিষ্যতেও হবেও না। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]