
বিশ্বের জনপ্রিয়তম ইনডোর গাছগুলোর মধ্যে এরিকা পাম অন্যতম। বসতবাড়ির শোভা বাড়াতে হোক বা অফিসরুম সাজাতে, এরিকা পাম অপরিহার্য। আশ্চর্যের কথা হলো, অতীতে একসময় নাকি এই গাছ বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির তালিকায় নাম তুলে ফেলেছিলো। যদিও বর্তমানে সর্বত্র এরিকার ছড়াছড়ি দেখলে সেকথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ইনডোর গাছ হিসেবে এরিকা পামের ব্যবহার প্রচুর হলেও এ গাছের যত্ন সম্পর্কে একটা কথা বলতেই হয়। এক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সাবধানতা দরকার। বিশেষ করে, এরিকা পামের যত্নে আলো ও জল, এই দুটো বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এরিকা পাম: উদ্ভিদ পরিচয়
এরিকা এক প্রজাতির পাম জাতীয় গাছ। এদিক থেকে এই গাছকে নারকেল, তাল ও খেজুর গাছের আত্মীয় বলা যায়। এরিকার বৈজ্ঞানিক নাম ডিপসিস লুটেসেন্স (Dypsis lutescens)। এই গাছ বাটারফ্লাই পাম, ব্যাম্বু পাম বা গোল্ডেন কেন পাম নামেও পরিচিত। আফ্রিকা মহাদেশের পূ্র্বদিকে ভারত মহাসাগরের বুকে জেগে থাকা বিশাল দ্বীপ মাদাগাস্কার হলো এই গাছের আদিনিবাস।
বাগানের মাটিতে লাগালে এরিকা পাম ২৫ ফুটেরও বেশি লম্বা হতে পারে। তবে টবে লাগালে সাধারণত এই গাছ ৫/৬ ফুটের চেয়ে বড়ো হওয়ার সুযোগ পায় না। পরিণত এরিকা গাছের গোড়া থেকে আরো গাছ বেরিয়ে ধীরে ধীরে একটা ঝাড় তৈরি হয়। সবুজ ঝিরিঝিরি পাতার রাশি নিয়ে গোটা ঝাড়টা দেখতে অপূর্ব সুন্দর লাগে।
এরিকা পামের পরিচর্যা
ইনডোর গাছ হিসেবে টবে এরিকা পাম লাগালে গাছের যত্নের কয়েকটা নিয়ম খেয়াল রাখতে হবে।
➤ এরিকা পামের জন্য উত্তম জলনিকাশি ব্যবস্থা-যুক্ত দোয়াঁশ অথবা বেলে-দোয়াঁশ মাটি দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। টবের সাইজ হতে পারে ৮ থেকে ১২ ইঞ্চি।
➤ এরিকার জন্য টবের মাটি তৈরির সময় কিছুটা জৈব সার মেশানো যেতে পারে। এছাড়া এই গাছে কোনো রকম রাসায়নিক সার লাগে না। মাসে দুই থেকে তিন বার তরল জৈব সার প্রয়োগ করলে এরিকার বৃদ্ধি খুব ভালো হয়।
➤ এরিকা পাম গাছের যত্নে জলসেচ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই গাছ খটখটে শুকনো মাটি একেবারেই ভালোবাসে না। আবার বেশি জলেও গোড়া পচে এই গাছ মরে যেতে পারে। তাই এই গাছে সর্বদা পরিমিত জল দেওয়া উচিত। ধরাবাঁধা রুটিনে জল দেওয়ার চেয়ে টবের মাটির অবস্থা দেখে জল দেওয়া ভালো।
➤ ট্যাপের জলে ক্লোরিন বা ফ্লুওরিন থাকলে সেই জল এরিকা পাম গাছে দেওয়া ঠিক নয়। দিলে পাতা হলুদ হয়ে গাছ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যদি একান্তই এ ধরনের ট্যাপের জল এরিকা পাম গাছে দিতে হয়, তবে তা অন্তত একদিন আগে বালতিতে তুলে রেখে, ওপরের দিক থেকে দিতে হবে।
➤ এরিকা পামের পাতা বাতাসের ভাসমান ধুলো আকর্ষণ করে। তাই পাতাগুলোকে মাঝেমধ্যে স্প্রেয়ার দিয়ে বা জল ছিটিয়ে ধুয়ে দেওয়া ভালো। তাতে পাতাগুলো তরতাজা থাকবে ও ঝকঝকে দেখাবে।
➤ এরিকা পাম ইনডোর গাছ হলেও এই গাছের জন্য কিছুটা সূর্যালোক অবশ্যই দরকার। একেবারে ছায়াচ্ছন্ন জায়গায় এই গাছ ভালো হয় না। প্রতিদিন সকালের দিকে তিনচার ঘন্টা প্রত্যক্ষ সূর্যালোক ও বাকি সময় পরোক্ষ সূর্যালোক পেলে এরিকা গাছের স্বাস্থ্য খুব ভালো থাকে। দুপুর বেলার কড়া রোদে রাখলে এর পাতা বাদামি হয়ে শুকিয়ে যেতে পারে।
➤ এরিকা পাম গাছ বেশি ঝাড়ালো হয়ে গেলে গাছ ছাঁটাই করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে গাছের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা কেটে দেওয়া যেতে পারে।
➤ এরিকা পামে রোগপোকার আক্রমণ কমই দেখা যায়। এ গাছকে উপযুক্ত মাটি, দরকার-মতো জল ও প্রয়োজনীয় আলো সহ সঠিক পরিবেশ দিতে পারলে এমনিতেই এর স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
➤ এরিকা পাম গাছের পাতা বাদামি হয়ে শুকিয়ে গেলে বুঝতে হবে গাছ দরকার মতো জল পাচ্ছে না অথবা খুব শুষ্ক পরিবেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে অথবা গাছে রোদের তাত বেশি লাগছে। রোগের কারণ বুঝে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে গাছ দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।
➤ এরিকা পাম গাছে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ সাধারণত দেখা যায়না। তবু যদি কখনো এ ধরণের রোগ হয়, রোগ মোকাবিলায় রাসায়নিক বিষ প্রয়োগ করার চেয়ে জৈব পদ্ধতি অবলম্বন করা ভালো। রোগ একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ধরতে পারলে, আক্রান্ত অংশ কেটে বাদ দিয়ে রোগের বিস্তার থেকে গাছকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যেতে পারে।
➤ এরিকা পাম গাছে স্কেল, মিলি বাগ বা অ্যাফিড জাতীয় পোকামাকড়ের আক্রমণ ঘটলে আক্রান্ত গাছটাকে প্রথমেই অন্যান্য গাছ থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। আক্রান্ত অংশ জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা যেতে পারে। নিম তেল প্রয়োগ করেও সুফল পাওয়া যাবে। আরেকটা পদ্ধতি হলো রাবিং অ্যালকোহল (আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল)-এ তুলো ভিজিয়ে আক্রান্ত অংশটা সাবধানে মুছে পরিষ্কার করে ফেলা। রাবিং অ্যালকোহল ওষুধের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
➤ টবে এরিকা পাম গাছ রাখলে বছরে একবার টব ও মাটি বদলে দিতে হবে। বদলানোর সময় এরিকার নতুন টব পুরোনো টবের চেয়ে একটু বড়ো হওয়া দরকার। গাছের ঝাড় যদি খুব ঝাঁকড়া হয়ে যায়, এই সময় সেটাকে ভাগ করে আলাদা আলাদা টবেও লাগানো যেতে পারে।
এরিকা পামের বিশেষ গুণ
ইনডোর গাছ হিসেবে এরিকা পাম ঘরের পরিবেশকে সুন্দর করে। এই গাছ বায়ু শোধনেও দারুণ দক্ষ। ঘরে এরিকা পামের ঝাড় থাকলে তা রীতিমতো একটা এয়ার পিউরিফাইং মেশিনের মতো কাজ করে। [আরো পড়ুন: ইনডোর প্ল্যান্টের উপকারিতা: গাছের গুণে বায়ু শোধন] এই গাছ পরিবেশে বাড়তি অক্সিজেন তো জোগায়ই, তার পাশাপাশি নানান দূষণকারি উদ্বায়ি জৈব যৌগ শোষণ করে ঘরের বাতাসকে নির্মল রাখতে সাহায্য করে, যেমন—
- অ্যাসিটোন
- বেঞ্জিন
- টলুইন
- জাইলিন
- ট্রাইক্লোরোইথেন, ইত্যাদি।
শেষের কথা
এরিকা ছাড়াও বায়ুশোধনকারি ইনডোর গাছ কম নেই, যেমন, যেমন ক্রোটন, পিস লিলি, মানি প্ল্যান্ট, ইত্যাদি। তবে এই গাছগুলোর পাতায় কিছুটা টক্সিক পদার্থ থাকায় এগুলো ঘরে রাখলে একটু সাবধান থাকতে হয়। এক্ষেত্রে এরিকা পামের একটা মস্তো বড়ো সুবিধা হলো: এই গাছের পাতায় বা কান্ডে কোনোরকম বিষাক্ত পদার্থ থাকে না। তাই ঘরে এই গাছ রাখলে কোনো বাড়তি সাবধানতার দরকার হয় না। এইসব কারণেই এরিকা পাম বর্তমানে বায়ু শোধনকারি ইনডোর গাছ হিসেবে এতোটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]