স্নেক প্ল্যান্ট : এক আদর্শ ইনডোর গাছ

স্নেক প্ল্যান্ট এক আদর্শ ইনডোর গাছ

গাছের নাম স্নেক প্ল্যান্ট! তবে এ গাছ বিষ ছড়ায় না মোটেই, বরং ঘরের বাতাস থেকে অনেক বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে নেয়। বায়ুশোধক ইনডোর গাছগুলোর তালিকায় স্নেক প্ল্যান্টের নাম আছে ওপর দিকেই। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় দিব্যি বেঁচে থাকে এই গাছ। এর জন্য খুব বেশি যত্ন দরকার হয় না। সহ্যশক্তির গুণে এ গাছ নানারকম পরিবেশে সহজেই মানিয়ে নিতে পারে।

স্নেক প্ল্যান্ট গাছের পরিচয়

উদ্ভিদজগতে স্নেক প্ল্যান্ট Asparagacea পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বহুবর্ষজীবী গাছ, বৈজ্ঞানিক নাম Sansevieria (গণ)। এ গাছের আদি নিবাস ছিলো নিরক্ষীয় পশ্চিম আফ্রিকা। সেখান থেকে এ গাছ এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এ গাছের পরিণত পাতার আকার সাপের ফণার মতো। এ থেকেই এর নাম হয়েছে স্নেক প্ল্যান্ট, যদিও কোনো কোনো দেশে একে Mother-in-law’s tongue বা শাশুড়ির জিভ নামেও ডাকা হয়।

স্নেক প্ল্যান্ট সপুষ্পক গাছ। সারা বিশ্বে এই গাছের প্রায় ৭০ রকম ভ্যারাইটি দেখা যায়। তার মধ্যে Sansevieria trifasciata অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভ্যারাইটি অনুযায়ি স্নেক প্ল্যান্ট গাছ ৮ ইঞ্চি থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। বসন্তকালে কখনো কখনো এই গাছে ফুল ফোটে। ফুলগুলো ছোটো ছোটো, সবুজাভ সাদা রঙের। মৃদু সুগন্ধযুক্ত ফুলগুলো একটা দন্ডের ওপর সাজানো থাকে।

সুন্দর পাতাই স্নেক প্ল্যান্টের প্রধান আকর্ষণ। পাতাগুলো সাধারণত লম্বাচওড়া হয়। রঙ গাঢ় সবুজ। তার ওপর থাকে হালকা সবুজ, সাদাটে, ধূসর রঙের নকশা। গাছের গোড়া থেকে স্নেক প্ল্যান্টের পাতাগুলো অনেকটা খাড়া ভাবে বেড়ে ওঠে। সামান্য যত্ন পেলেই গাছ বড়ো হয় ও পাতার গোছা ঘন হয়ে ওঠে। কয়েক জাতের স্নেক প্ল্যান্ট গাছে পাতার চারপাশে হলদেটে বা রুপালি রঙের বর্ডার দেখতে পাওয়া যায়।

স্নেক প্ল্যান্টের উপকারিতা

বাগান সাজানোর জন্য স্নেক প্ল্যান্ট গাছ লাগানো যায়। তাছাড়া ঘরের ভেতরে টবের সাহায্যে এই গাছ রাখা যায়। স্নেক প্ল্যান্টের জন্য খুব বেশ যত্ন দরকার হয় না। শুধু সৌন্দর্য বাড়ানো নয়, এই গাছের আরো অনেক উপকারিতা আছে। এ গাছ ঘরের বাতাসে জমে ওঠা নানান বিষাক্ত যৌগের বাষ্প দূর করতে দারুণ কার্যকর, যেমন—

  • ফরম্যালডিহাইড,
  • বেনজিন,
  • টলুইন,
  • জাইলিন, ইত্যাদি।

স্নেক প্ল্যান্ট গাছ রাতেও কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। পৃথিবীর খুব কম গাছেরই এই গুণ আছে [Wikipedia]। স্নেক প্ল্যান্টের এই গুণগুলো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে।

বায়ু শোধনের জন্য বাড়ির বসার ঘর, শোবার ঘর ও রান্না ঘরে স্নেক প্ল্যান্টের টব রাখা যেতে পারে। বাথরুমেও কয়েকটা স্নেক প্ল্যান্ট গাছ রাখা ভালো। এছাড়া অফিসরুম, শোরুম, কারখানা চত্বর, হসপিটাল, ইত্যাদি জায়গাতে এই গাছ বেশি সংখ্যায় রাখা উচিত। বিশেষ করে, যেসব ঘরে ভেন্টিলেশন ভালো নয়, বা যে সব ঘরে এয়ারকন্ডিশনার আছে, সেখানে স্নেক প্ল্যান্ট (বা অন্য কোনো ভালো বায়ু শোধক ইনডোর গাছ) অবশ্যই রাখা উচিত। [ইনডোর গাছ সম্পর্কে আরো জানতে পড়ুন ➤ ইনডোর প্ল্যান্ট: বাহারি ঘরোয়া গাছে ঘরের দূষণ কমান]

স্নেক প্ল্যান্টের বংশবিস্তার

রাইজোমের সাহায্যে স্নেক প্ল্যান্ট বংশবৃদ্ধি করে। পরিণত গাছের গোড়ার নিচের দিক থেকে নতুন চারা বেরোয়। এরকম একটা চারা অন্তত ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি বড়ো হলে শিকড় সহ সেটাকে ছুরি দিয়ে মূল গাছের থেকে কেটে আলাদা করতে হবে। এরপর চারাটা টবের বা বাগানের মাটিতে লাগিয়ে দিলে নতুন গাছ পাওয়া যাবে। টবের মাটি বদলানোর সময় স্নেক প্ল্যান্টের চারাগুলোকে এইভাবে ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে লাগানো যায়। এছাড়া পাতার কাটিং থেকেও সহজে স্নেক প্ল্যান্ট গাছের চারা তৈরি করা যায়।

স্নেক প্ল্যান্টের সৌন্দর্য

স্নেক প্ল্যান্টের যত্ন

ঘরর ভেতর টবে রাখা স্নেক প্ল্যান্টের জন্য খুব বেশি যত্ন দরকার হয়না। তবে কয়েকটা বিষয় মনে রাখতে হবে।

★ স্নেক প্ল্যান্টের জন্য ক্যাকটাস বা সাকিউলেন্ট গাছের মতো মাটি দরকার। অর্থাৎ, ভালো জল নিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত উর্বর দোঁয়াশ বা বেলে-দোঁয়াশ মাটিতে এই গাছ ভালো হবে।

★ টবে স্নেক প্ল্যান্ট গাছ রাখতে চাইলে, মাটি তৈরির সময় কিছুটা জৈব সার মেশানো যেতে পারে। এরপর চার থেকে ছয় মাস অন্তর টবের মাটিতে অল্প পরিমানে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া প্রতিবছর স্নেক প্ল্যান্টের টব ও মাটি বদলে দেওয়া উচিত।

★ স্নেক প্ল্যান্ট গাছের যত্নে জলসেচ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুকনো মাটিতে এই গাছের যা ক্ষতি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয় অতিরিক্ত জল দিলে। তাই স্নেক প্ল্যান্ট গাছে সর্বদা পরিমিত জল দিতে হবে। গাছের গোড়ায় যেনো কোনোভাবেই জল জমে না থাকে।

★ ট্যাপের জলে ক্লোরিন বা ফ্লুওরিন থাকলে সেই জল স্নেক প্ল্যান্ট গাছে না দেওয়াই ভালো। যদি একান্তই এধরনের ট্যাপের জল স্নেক প্ল্যান্ট গাছে দিতে হয়, তবে তা বালতিতে অন্তত একদিন রেখে ওপরের দিক থেকে দিতে হবে।

★ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সূর্যালোক, দুই অবস্থাতেই স্নেক প্ল্যান্ট গাছ সুন্দর মানিয়ে নিতে পারে। তবে দুপুর বেলার প্রখর রোদ, বিশেষ করে গরম কালে, এই গাছের পক্ষে ভালো নাও হতে পারে। ঘরের ভেতর টবে স্নেক প্ল্যান্ট গাছ রাখলে সেটাকে সারাদিনে অন্তত কয়েক ঘন্টা পরোক্ষ সূর্যালোক ও সকালের দিকে কিছুক্ষণ নরম রোদ খাওয়াতে পারলে ভালো হবে।

★ স্নেক প্ল্যান্ট গাছে রোগ পোকার আক্রমণ খুব কমই দেখা যায়। তবু কয়েকটা সাবধানতা রাখা ভালো। প্রথম কথা হলো, গাছের চারা সংগ্রহ করার সময়ই দেখে নিতে হবে যে সেটা সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত। এরপর দেখতে হবে যাতে গাছ মনের আনন্দে বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পায়। মনের মতো পরিবেশ পেলে যে কোনো গাছেরই নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ শক্তি চাঙ্গা থাকে।

★ অতিরিক্ত জল দিলে স্নেক প্ল্যান্ট গাছে গোড়া-পচা রোগ হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। এ রোগ একবার ধরে নিলে গাছকে বাঁচানো মুশকিল। এ রোগ এড়ানোর উপায় হলো স্নেক প্ল্যান্ট গাছে কখনো অতিরিক্ত জল না দেওয়া ও গাছের গোড়ায় কখনো জল জমতে না দেওয়া।

★ ধুলো জমে গেলে স্নেক প্ল্যান্ট গাছের পাতাগুলো মলিন দেখায়। তাই মাঝে মধ্যে স্প্রেয়ার দিয়ে জল ছিটিয়ে পাতাগুলো ধুয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে স্নেক প্ল্যান্টের পাতাগুলো ঝলমলে দেখাবে।

★ স্নেক প্ল্যান্ট গাছের যত্ন সম্পর্কে ইউটিউবে অনেক বাংলা, হিন্দী ও ইংরাজি ভিডিও পাওয়া যায়। দরকার মতো এই ভিডিওগুলোর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য ইউটিউবের সব ভিডিও-ই সমান ভরসাযোগ্য নয়। তাই স্নেক প্ল্যান্টের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও বিচার বুদ্ধিও প্রয়োগ করতে হবে।

সাবধানতা

ঘরে স্নেক প্ল্যান্ট রাখলে একটা বিষয়ে একটু সাবধান থাকা দরকার। এই গাছের পাতা খেয়ে ফেললে মুখে ও গলায় অস্বস্তি, বমিবমি ভাব, বমি, ডাইরিয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই কারণে বাড়িতে ছোটো বাচ্চা ও পোষ্য থাকলে স্নেক প্ল্যান্টের টব তাদের নাগালের বাইরে রাখা ভালো।

স্নেক প্ল্যান্ট এক চমৎকার ইনডোর গাছ

যে কোনো ভালো নার্সারি থেকে স্নেক প্ল্যান্ট গাছ সংগ্রহ করা যায়। অনলাইনে অর্ডার দিয়েও এ গাছ আনিয়ে নেওয়া যায়। কেবল বাড়ির বাগানেই নয়, যে কোনো ঘরের ভেতরে টবের সাহায্যে অল্প যত্নে স্নেক প্ল্যান্ট গাছ রাখা যায়। এই গাছ ঘরে রাখলে ঘরের শোভা যেমন বাড়ে, ঘরের বাতাসও তেমনই শুদ্ধ থাকে। অর্থাৎ, ঘরে এই উপকারি গাছটা রাখা মানে আমাদের ডবল লাভ। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]