বাড়ির পরিবেশকে রঙীন করতে হলে অনেকেরই ফুল গাছের কথা মনে পড়ে। কিন্তু ফুল গাছ ছাড়াও যে আমাদের চারপাশকে বর্ণময় করে তোলা যায়, ক্রোটন তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ। এ জাতীয় গাছকে আমরা সাধারণভাবে পাতাবাহার বলি। রঙবাহারি পাতার জাদুতে এ গাছ যে কোনো মানুষের মন জয় করে নিতে পারে। এছাড়া ক্রোটনের আরো একটা উপকারিতা আছে। এই গাছ হলো এয়ার পিউরিফাইং প্ল্যান্ট, অর্থাৎ, বায়ু শোধনকারি গাছ। বাগানে বা টবে লাগালে এই গাছের জন্য খুব বেশি যত্ন দরকার হয় না। এককথায় বলতে গেলে, ক্রোটন বা পাতাবাহার হলো সামান্য যত্নের অপূর্ব সুন্দর গাছ।
ক্রোটন গাছের পরিচয়
আদতে ক্রোটন, অর্থাৎ পাতাবাহার হলো গুল্ম জাতীয় চিরহরিৎ গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Codiaeum variegatum। এই গাছ বহুবর্ষজীবী। এ গাছের আদিনিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিরক্ষীয় অঞ্চল। সেখান থেকে মানুষের চেষ্টায় ও যত্নে এ গাছ প্রায় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রোটন সপুষ্পক উদ্ভিদ, পরিণত গাছে ফুল হয়। তবে সেই ফুল তেমন চোখ টানার মতো নয়। ক্রোটনের প্রধান আকর্ষণ এর বর্ণবৈচিত্রে ভরা পাতা। সুদৃশ্য পাতার জন্যই এই জাতীয় গাছকে আমরা পাতাবাহার বলে থাকি।
ক্রোটন গাছের পাতা সাধারণত বেশ লম্বাচওড়া। পাতাগুলো নানান আকার ও আকৃতির হয়। এগুলোর ওপর গাছের ভ্যারাইটি অনুযায়ি থাকে হালকা সবুজ, হলুদ, সাদা, কমলা, লাল, পার্পেল, গোলাপি, মেরুন ইত্যাদি নানা রঙের খেলা। একই গাছের পাতাগুলোর মধ্যে আকার-আকৃতি ও রঙরূপের অনেক বৈচিত্র থাকতে পারে। বাগানে লাগালে ক্রোটনের কোনো কোনো জাত ১০ ফুট বা তারও বেশি উঁচু হতে পারে। তবে টবে লাগালে ক্রোটন জাতীয় পাতাবাহার গাছ সাধারণত ৩ ফুটের বেশি বাড়ার সুযোগ পায় না। |
ভ্যারাইটি
প্রাকৃতিক ভাবেই ক্রোটন গাছের অনেক জাত আছে। তার ওপর সংকরায়ণের মাধ্যমে বাগানিরা এ গাছের বহু ভ্যারাইটি সৃষ্টি করেছেন। এখন সারা বিশ্বে ক্রোটনের অন্তত তিন/চার শ’ জনপ্রিয় ভ্যারাইটি আছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটা বিখ্যাত পাতাবাহারের নাম,—
- বুশ অন ফায়ার,
- পেট্রা,
- গোল্ড স্টার,
- রেড আইসটন,
- মাদার অ্যান্ড ডটার,
- ম্যামি ক্রোটন,
- রেইনবো ক্রোটন,
- ক্রোটন জাঞ্জিবার, ইত্যাদি।
ক্রোটনের উপকারিতা
বাগান সাজানোর গাছ হিসেবে ক্রোটন চমৎকার। রঙের মায়াজাল বিছিয়ে এ জাতীয় পাতাবাহার গাছ সহজেই মানুষের মন কেড়ে নেয়। তবে, এ গাছের উপকারিতা শুধু এটুকুই নয়। ক্রোটন অল্প যত্নের এক চমৎকার বায়ুশোধনকারি গাছ। ঘরের ভেতরে রাখলে এই গাছ বাতাস থেকে শুষে নিতে পারে অনেক বিষাক্ত যৌগের বাষ্প, যেমন, ফরম্যালডিহাইড, বেনজিন, জাইলিন, টলুইন, ইত্যাদি। এ কারণে ইনডোর গাছ বা ঘরোয়া গাছ (Houseplants) হিসেবেও ক্রোটনের দারুণ কদর।
ইনডোর ক্রোটন গাছ
ক্রোটন জাতীয় পাতাবাহার গাছের যত্ন
সাধারণত খুব বেশি যত্ন ছাড়াই ক্রোটন গাছ ভালো ভাবে বেড়ে ওঠে। এ গাছের সহ্যশক্তি যথেষ্ট। বিভিন্ন জায়গায় এ জাতীয় পাতাবাহার গাছ মানিয়ে নিতে পারে। তবে উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু যুক্ত পরিবেশ ক্রোটনের সবচেয়ে পছন্দের।
➤ ক্রোটন গাছের চারা তৈরি করা সহজ। গাছের আগার দিক থেকে কমবেশি ৬ ইঞ্চি লম্বা ডাল কেটে নিয়ে গ্রন্থি সমেত নিচের দেড়/দু ইঞ্চি অংশ ভেজা মাটিতে পুঁতে দিলে শিকড় বেরিয়ে নতুন গাছ তৈরি হয়। এভাবে ক্রোটনের চারা তৈরি করতে প্রায় মাস খানেক সময় লাগে। এছাড়া গুটি কলমের সাহায্যেও এ গাছের চারা তৈরি করা যায়।
➤ ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে ক্রোটন জাতীয় পাতাবাহার গাছ লাগাতে চাইলে একটু বড়ো (অন্তত ৯ ইঞ্চি) টবে লাগানো উচিত।
➤ উর্বর দোয়াঁশ বা বেলে-দোয়াঁশ মাটি ক্রোটনের পক্ষে ভালো। টবে এ গাছ লাগাতে চাইলে মাটি তৈরির সময় দরকার মতো জৈব সার মেশাতে হবে। এই গাছের জন্য রাসায়নিক সারের কোনো প্রয়োজন নেই। মাসে একবার হালকা জৈব সার দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া, টবে লাগালে প্রতি বছর ক্রোটন জাতীয় পাতাবাহার গাছের টব ও মাটি বদলে দেওয়া উচিত।
➤ টবের ক্রোটনের যত্ন বলতে বিশেষ করে যেটা বলার, নিয়মিত গাছে জল দিতে হবে। জলের অভাব ঘটলে গাছের ক্ষতি অনিবার্য। তবে, রুটিন বেঁধে জল দেওয়ার থেকে মাটি পরীক্ষা করে ক্রোটনে জল দেওয়া ভালো। অর্থাৎ, চোখে দেখে ও আঙুলের ডগা দিয়ে পরীক্ষা করে যখন বোঝা যাবে টবের মাটি প্রায় শুকিয়ে গেছে, তখন পরিমিত জল দিতে হবে।
➤ ক্রোটন গাছ অতিরিক্ত জল একেবারেই ভালোবাসে না। এ গাছে খুব বেশি জল দিলে বা গাছের গোড়ায় জল জমে থাকলে, গোড়া ও শিকড় পচে গাছ মরে যেতে পারে।
➤ ট্যাপের জলে ক্লোরিন বা ফ্লুওরিন থাকলে সেই জল টবের ক্রোটন গাছে (বা অন্য কোনো গাছে) না দেওয়াই ভালো। যদি একান্তই এধরনের ট্যাপের জল টবের গাছে দিতে হয়, তবে তা বালতিতে অন্তত একদিন রেখে ওপরের দিক থেকে নিয়ে দিতে হবে।
➤ ক্রোটন জাতীয় পাতাবাহার গাছের যত্নে রোদ খুব জরুরি বিষয়। নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে আসা এই গাছ সূর্যের আলো ভালোবাসে। ঘরের ভেতর টবে ক্রোটন গাছ রাখলে প্রতিদিন অন্তত ৪ থেকে ৬ ঘন্টা যাতে সেটা রোদ পায় তা দেখতে হবে। যথেষ্ট রোদ না পেলে গাছের বাড় ভালো হবে না, পাতার রঙবাহারও তৈরি হবে না। তবে অতি প্রখর রোদে ক্রোটনের ক্ষতি হতে পারে। এসি বা হিটার যুক্ত ঘরে রাখলেও এ জাতীয় গাছ স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ে।
➤ ক্রোটন গাছ আর্দ্র জলবায়ুর ভক্ত। তাই মাঝে মাঝে স্প্রেয়ার দিয়ে জল ছিটিয়ে গাছের যত্ন নিতে পারলে ভালো হয়। এতে গাছ তরতাজা থাকে। তাছাড়া ক্রোটনের পাতায় সহজেই ধুলো জমে যায়। স্প্রেয়ার দিয়ে জল ছিটিয়ে পাতাগুলো ধুয়ে দিলে সেগুলো ঝলমলে দেখায়।
➤ বাগানের বা টবের ক্রোটন গাছে প্রুনিং বা ছাঁটাই করার দরকার হতে পারে। সাধারণত গাছের আকার-আকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে এ জাতীয় পাতাবাহার গাছে প্রুনিং করা হয়। এছাড়া গাছের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা বা রোগ লাগা ডালপাতাও কেটে বাদ দেওয়া যেতে পারে।
➤ সঠিক পরিবেশে রেখে একটুখানি যত্ন নিলেই ক্রোটন গাছে রোগপোকার আক্রমণ কম হয়। ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ দেখা দিলে রাসায়নিক বিষ প্রয়োগের বদলে জৈব পদ্ধতি অনুসরণ করা ভালো। নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরতে পারলে, আক্রান্ত অংশ কেটে বাদ দিয়ে গাছকে বাঁচানো যায়। এছাড়া ক্ষতিকর পোকামাকড়দের দূরে রাখতে ক্রোটন গাছে মাঝেমধ্যে তামাক পাতা ভেজানো জল স্প্রে করা যেতে পারে।
➤ ক্রোটন জাতীয় পাতাবাহার গাছে কখনোসখনো স্কেল, মিলি বাগ বা মাইট জাতীয় পোকামাকড়ের আক্রমণ ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত অংশটা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা যেতে পারে। নিম তেল প্রয়োগেও সুফল পাওয়া যায়। আরেকটা পদ্ধতি হলো রাবিং অ্যালকোহল বা আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল-এ তুলো ভিজিয়ে আক্রান্ত অংশটা মুছে ফেলা। এই অ্যালকোহল ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়। এছাড়া মিলি বাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে গাছের ভেতর লেডি বাগ পোকা ছেড়ে দিয়েও অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
রঙের জাদুকর ক্রোটন গাছ
টবের ক্রোটনের একটা বিশেষ সমস্যা ও তার সমাধান
ক্রোটন জাতীয় পাতাবাহার গাছ টবে লাগালে প্রথমে বছর দুই দেখতে খুব ভালো লাগে। এরপর গাছ বেড়ে গেলে গোড়ার দিকে বেশ খানিকটা অংশ পাতাবিহীন হয়ে পড়ে। তখন আর গাছকে দেখতে ততোটা আকর্ষণীয় লাগে না।
দুটো উপায়ে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। প্রথম উপায় হলো, গাছ যাতে গোড়ার দিক থেকে ডালপালা ছাড়ে তার জন্য ছয় ইঞ্চি কান্ড রেখে বাকি অংশ কেটে ফেলতে হবে। কেটে ফেলার সাত দিন পর গাছের গোড়ার কিছুটা মাটি তুলে ফেলে সেখানে সারমাটি দিতে হবে। এরপর সামান্য যত্নেই মাস কয়েকের মধ্যে ক্রোটন গাছ আবার নতুন ডালপালা ছেড়ে সুদৃশ্য হয়ে উঠবে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বর্ষার প্রথম দিকে গাছের স্বাস্থ্যবান ডালগুলোতে পাতাবহুল অংশের ঠিক নিচে গুটিকলম বাঁধতে হবে। কলমগুলো তৈরি হয়ে গেলে কেটে নিয়ে উপযুক্ত টবে লাগিয়ে দিতে হবে।
সাবধানতা
ঘরে ক্রোটন জাতীয় পাতাবাহার গাছ রাখলে দুএকটা বিষয় মনে রাখা দরকার। এটা কোনো খাবার গাছ নয়। এই গাছের কান্ড ও পাতা কেউ বেশি পরিমানে খেয়ে ফেললে বমি বা ডাইরিয়া জাতীয় উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ক্রোটনের রস চামড়ায় লাগলেও একটু জ্বলুনি হতে পারে। তাই বাড়িতে ছোটো বাচ্চা বা পোষ্য প্রাণী থাকলে ক্রোটনকে তাদের নাগালের একটু বাইরে রাখা ভালো। তাছাড়া ক্রোটনের রস জামাকাপড়ে লাগলে দাগ পড়ে যায়, এটাও মাথায় রাখতে হবে।
অল্প যত্নের চমৎকার বাহারি গাছ
সংক্ষেপে বলতে গেলে, অসাধারণ রঙবাহারি গাছ ক্রোটন। বায়ুশোধক গাছ হিসেবেও এর উপকারিতা আছে। খুব কম যত্নেই সুন্দরভাবে বেড়ে উঠে এ গাছ বাড়ির পরিবেশকে রঙে রঙে রাঙিয়ে তোলে। এই সব কারণেই বাগানে বা ঘরে রাখার গাছ হিসেবে ক্রোটন আজ এতো জনপ্রিয়|| [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]