একসময় ভাবা হতো কচুরিপানা হলো ক্ষতিকর আগাছা। এ দেশের জল থেকে একে নির্মূলের চেষ্টা অতীতে কম হয়নি। কিন্তু সময় ও অর্থের অপচয় ছাড়া তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেসব বাদ দিয়ে একালে শুরু হয়েছে নতুন চেষ্টা— কচুরিপানার মধ্যে কী কী গুণ আছে খুঁজে বার করে কাজে লাগানোর চেষ্টা। এখন বোঝা যাচ্ছে, যাকে এতোদিন ক্ষতিকর আগাছা বলে ভাবা হতো সেই কচুরিপানার উপকারিতা কম নয়। এ পানার বহুমুখী ব্যবহার জানলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
কচুরিপানার কাহিনী
ভাসমান জলজ গাছ কচুরিপানার বৈজ্ঞানিক নাম Eichhornia crassipes। এর আদি নিবাস ছিলো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের আমাজন অঞ্চলে। সেখান থেকে ১৮ শতকে ইউরোপীয় পর্যটকদের হাত ধরে এই পানা ঢুকে পড়ে বাংলায়। তবে বিশেষ কোনো উপকারিতা নয়, বরং এ গাছের হালকা বেগুনি রঙের সুন্দর ফুল সে সময় পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছিলো।
কচুরিপানার বাড় অবিশ্বাস্য। অঙ্গজ জনন প্রক্রিয়ায় এই গাছ খুব তাড়াতাড়ি সংখ্যায় বাড়ে। অনুকূল পরিবেশে কচুরিপানা এক সপ্তাহের মধ্যে বেড়ে দুগুণ হতে পারে। এছাড়া এ গাছ বীজের দ্বারাও বংশবৃদ্ধি করে। এক একটা কচুরিপানা গাছ থেকে ৫০০০-এরও বেশি বীজ তৈরি হতে পারে। বীজগুলোর এমন গুণ যে এগুলো সহজে নষ্ট হয় না। দেখা গেছে ৩০ বছর পরেও কচুরিপানার বীজ থেকে অঙ্কুর বেরোতে পারে। |
এ দেশে আসার পর কচুরিপানা দ্রুত ছড়িয়ে যায়। কয়েক দশকের মধ্যেই বাংলার পুকুর ডোবা নদীনালা খালবিল হাওড় বাওড় জলা এই পানায় ভরে যায়। এর ফলে মাছচাষ ও মাছধরা ব্যাহত হয়। অনেক জায়গায় নৌচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে এ পানা ধানের নিচু জমি ও পাটখেতেও ছড়িয়ে পরে। তাতে এই ফসলগুলোর চাষও ব্যাহত হয়। কচুরিপানার যে কিছু উপকারিতা থাকতে পারে এটা সেসময় কেউ ভাবতেই পারেনি।
বাংলার জনমানসে কচুরিপানার প্রতি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো খুবই বিরূপ। সে সময় দেশ থেকে এই পানা নির্মূলের জন্য দিকে দিকে আওয়াজ উঠেছিলো। তখন থেকে দশকের পর দশক চলেছে কচুরিপানার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের লড়াই। তবে তাতে যে বিরাট কিছু লাভ হয়েছে তা নয়। আসলে, এই জলজ গাছটা এদেশের আবহাওয়ায় এতোটাই খাপ খাইয়ে নিয়েছে যে একে একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। বরং বুদ্ধিমানের কাজ হলো: কচুরিপানার মধ্যে কী কী গুণ আছে খুঁজে দেখা ও সেগুলো যাতে কাজে লাগে সেই ব্যবস্থা করা। এটা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক কালে কচুরিপানার বিশেষ বিশেষ উপকারিতা ও নানান ব্যবহার সামনে এসেছে। সেগুলো রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো।
কচুরিপানার বহুমুখী ব্যবহার
জৈব সার উৎপাদনে কচুরিপানা
কচুরিপানার একটা গুণ হলো, এই পানা জল থেকে নানান ধাতব লবণ ও অধাতব যৌগ শুষে নেয়। এই পানাকে কাজে লাগিয়ে জৈব সার তৈরি করলে তাতে পটাশিয়াম, ফসফরাস, নাইট্রোজেন, ইত্যাদি উপাদান বেশি মাত্রায় থাকে। ঐ সার হয় খুব উন্নত মানের। তাছাড়া কচুরিপানা পচে সার হতে সময় লাগে মাত্র দু মাস, অন্যান্য জৈব সারের থেকে বেশ কম। গ্রামবাংলায় এর জোগানও অপর্যাপ্ত। আজকাল কৃষিভিত্তিক এলাকাগুলোতে যেভাবে দিনদিন গোবরের লভ্যতা কমে আসছে তাতে আগামী দিনে কচুরিপানাই হয়ে উঠতে পারে জৈব সার উৎপাদনের মূল উৎস। এই পানা ব্যবহার করে লাভজনকভাবে জৈব গ্যাস তৈরি করাও সম্ভব।
ভাসমান কচুরিপানার বেডে সবজি চাষ
কচুরিপানার ভাসমানতার গুণ কাজে লাগিয়ে এর ওপরেই করা যায় সবজি চাষ। পদ্ধতি খুবই সহজ। বাঁশের সাহায্যে জলের ওপরেই ফ্রেম তৈরি করা হয়। তার মধ্যে কয়েকটা স্তরে কচুরিপানা গাদা করে জমিয়ে বেড বানানো হয়। গাদার পানা কয়েকদিনের মধ্যেই পচে যায়। কচুরিপানার এমনই উপকারিতা যে ঐ বেডে রাসায়নিক সার দেবার দরকারই হয় না। বেডের ওপরে কিছুটা মাটি ছড়িয়ে দিলেই যথেষ্ট।
কচুরিপানার অভিনব ব্যবহার: ভাসমান বেডে সবজি চাষ
সাধারণত এক একটা ভাসমান বেড শখানেক ফুট লম্বা ও পাঁচ-সাত ফুট চওড়া হয়। এই বেডে চাষ করা যায় প্রায় সব রকম শাক সবজি। যেমন—
- লাল শাক,
- পুঁই শাক,
- কলমী শাক,
- ডাটা,
- মূলো,
- লাউ,
- কুমড়ো, ইত্যাদি।
কচুরিপানার গুণে ভাসমান চাষে সবজির ফলন যথেষ্ট ভালো হয়। চাষ কম খরচের ও লাভজনক। বাংলাদেশে কচুরিপানাকে কাজে লাগিয়ে এধরণের ভাসমান সবজি চাষ ইতিমধ্যেই ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হয়েছে।
পশুখাদ্য তৈরিতে কচুরিপানার ব্যবহার
কচুরিপানার পাতায় প্রচুর পুষ্টি গুণ থাকায় গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, শূকর ইত্যাদি পশুর খাবার হিসেবে কাজে লাগে; তাছাড়া মাছের খাবার হিসেবে ও হাঁস-মুরগীর খাবার হিসেবেও কচুরিপানা ব্যবহার করা সম্ভব। এমনিতে অক্সালেট কেলাস থাকায় শাকাহারী প্রাণীরা এই পানার কাঁচা পাতা খেতে ততোটা পছন্দ করে না। তবে কচুরিপানার পাতা কুচিয়ে গুড়, লবণ, ধানের কুড়ো, ভুট্টার কুড়ো, সয়াবিন গুঁড়ো ইত্যাদির সাথে মিশিয়ে উন্নত মানের পশুখাদ্য রূপে ব্যবহার করা যায়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে কচুরিপানাকে এ ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
জল শোধনে কচুরিপানার উপকারিতা
জল শোধনে কচুরিপানা বিশেষ উপকারিতার পরিচয় দেয়। যে সব জলাভূমিতে দূষিত জল এসে মেশে সেখানে দারুণ কাজে লাগে এই গাছ। কচুরিপানার মূল দূষিত জল থেকে ক্যাডমিয়াম, নিকেল, জিংক, সীসা, পারদ, ইত্যাদি ভারি ধাতু শোষণ করে নেয়। কচুরিপানার গুণে সেখানে মাছ চাষও সম্ভব হয়। গাছেদের ব্যবহার করে দূষিত জল শোধনের এই পদ্ধতিকে ইংরাজিতে বলা হয় ফাইটোরেমেডিয়েশন।
আসবাব তৈরিতে কচুরিপানা
কচুরিপানা থেকে তৈরি করা যায় সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র। এর জন্য জল থেকে তুলে কচুরিপানার ডাঁটিগুলো প্রথমে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। এরপর সেগুলো রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। সব শেষে শুকনো ডাঁটিগুলো থেকে ফিতে কেটে কাঠ বা স্টিলের ফ্রেমের ওপর জড়িয়ে সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র ও ঘর সাজানোর জিনিস তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
কচুরিপানার আসবাব
এই আসবাবগুলো শুধু সুন্দরই হয় না, এগুলোর আরো একটা গুণ আছে। এগুলো থেকে এক ধরণের মৃদু সুবাস পাওয়া যায়। ইদানিংকালে কচুরিপানার আসবাব চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেক দেশে কচুরিপানার তন্তু বস্ত্র ও কাগজ শিল্পেও কাজে লাগে।
শেষের কথা
এখন আমরা বুঝতে পারছি ‘আগাছা’ কচুরিপানার কতো গুণ, কতো উপকারিতা! কতোরকম ভাবে কাজে লাগতে পারে কচুরিপানা! বহুমুখী ব্যবহার দেখে এরপর থেকে যদি কচুরিপানাকে জলের আগাছা না বলে জলের সম্পদ বলা হয়, খুব একটা ভুল হবে কি? [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]