বিশ্ব উষ্ণায়ন ও প্রতিকার ভাবনা

বিশ্ব উষ্ণায়ন এ যুগের জ্বলন্ত সমস্যা।

বিশ্ব উষ্ণায়ন এ যুগের জ্বলন্ত সমস্যা। সাম্প্রতিক কালে এ নিয়ে সারা পৃথিবীতে কম গবেষণা হয়নি। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলাফল মানবজাতির পক্ষে শুভ হবে না।

বিশ্ব উষ্ণায়নের সংজ্ঞা

বিশ্ব উষ্ণায়ন কাকে বলে? সহজ কথায় এর অর্থ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উষ্ণ হয়ে ওঠা। দেখা গেছে, বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা সাম্প্রতিক পর্যায়ে লক্ষণীয় ভাবে বেড়ে চলেছে। একেই বলা হচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। বিজ্ঞানীরা বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ হিসেবে প্রধানত মানুষের নানা বেপরোয়া কাজকেই দায়ি করেছেন।

উষ্ণায়নের তথ্য

তথ্য বলছে, নিম্ন-বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা গত ১৫০ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে বেড়ে চলেছে। এখনকার বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের চেয়ে প্রায় ১ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বেশি। আবহাওয়া বিষয়ক রেকর্ড শুরুর পর থেকে ২০১০-১৯ ছিলো উষ্ণতম দশক। তার মধ্যে ২০১৬ সাল ছিল উষ্ণতম বছর, দ্বিতীয় উষ্ণতম ২০১৯। শুধু তাই নয়, আবহাওয়া-রেকর্ড শুরুর পর থেকে ৯টা উষ্ণতম বছরের সবগুলোই দেখা গেছে ২০০৫ সাল থেকে। আর ৫টা উষ্ণতম বছরের সবগুলোই দেখা গেছে গত পাঁচ বছরে। অর্থাৎ বিশ্ব উষ্ণায়ন যে আশংকাজনক মাত্রায় ঘটছে, তথ্য দেখলে সেটা না মেনে উপায় নেই। [wikipedia]

উষ্ণায়নের ভবিষ্যৎ

এই হারে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটতে থাকলে ফলাফল কী হতে পারে তাও বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন। তারা জানিয়েছেন, এভাবে চলতে থাকলে ২১ শতকের শেষ নাগাদ বায়ুর গড় উষ্ণতা আজকের তুলনায় প্রায় ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বেড়ে যাবে। বিশ্বের অতোখানি উষ্ণায়ন যে মানুষের জন্য বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে সেটা সহজেই বোঝা যায়।

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রবণতা

বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ: প্রাকৃতিক ও মানব-সৃষ্ট

মানুষ নিজে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য অনেকটা দায়ি। তবে এর পেছনে কিছু প্রাকৃতিক কারণও আছে। অতীতের নানা সাক্ষ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা গত ১০ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্রমাগত বাড়ছে। অতীতে সেই বৃদ্ধির হার ছিলো বেশ কম। গত ১০০/১৫০ বছরে মানুষের নানা হঠকারি কাজ প্রাকৃতিক উষ্ণায়নকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে বিপদ ডেকে এনেছে।

গ্রীন হাউস এফেক্ট

বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ খুঁজতে গেলে আগে গ্রীন হাউস এফেক্ট ব্যাপারটা একটু দেখে নিতে হয়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উষ্ণ হওয়ার প্রক্রিয়া গ্রীন হাউস এফেক্ট নামে পরিচিত। ব্যাপারটা এরকম। সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠে পড়ার পর সেখান থেকে তাপশক্তি রূপে বিকিরিত হয়। বায়ুমন্ডলে থাকা কয়েকটা গ্যাস সেই তাপ শোষণ করে নেয়। ফলে বায়ু উষ্ণ হয়ে ওঠে। এই গ্যাসগুলোকে বলা হয় গ্রীন হাউস গ্যাস। বায়ুমন্ডলে এই গ্যাসগুলোর পরিমাণ যতো বাড়বে ততোই বায়ুমন্ডল উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হতে থাকবে। ঘটবে বিশ্ব উষ্ণায়ন। প্রক্রিয়াটা গ্রীন হাউস বা কাচের ঘরের মধ্যে বায়ুর উষ্ণ হয়ে ওঠার সাথে তুলনীয়। শীতপ্রধান দেশগুলোতে সব্জি চাষের জন্য গ্রীন হাউস তৈরি করে বাতাসকে উষ্ণ রাখা হয়।

গ্রীন হাউস এফেক্ট

উষ্ণায়নে কার্বন নির্গমনের ভূমিকা

পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বেশ কয়েকটা গ্রীন হাউস গ্যাস রয়েছে। যেমন, কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2), নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2), মিথেন (CH4), ওজোন (O3), জলীয় বাষ্প ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে CO2–র ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কারণ, এই গ্যাসটাই মানুষের নানা কর্মকান্ডে অনেক বেশি তৈরি হচ্ছে।

এমনিতে CO2 বায়ুমন্ডলের একটা স্বাভাবিক উপাদান। তবে শিল্প বিপ্লবের যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে, গত ১৫০ বছরে, মানুষের নানা কাজে বায়ুর গঠনগত ভারসাম্য অনেকটা নষ্ট হয়েছে। এই পর্যায়ে বায়ুমন্ডলে CO2-র অনুপাত কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এটা বিশ্ব উষ্ণায়নের একটা বড়ো কারণ। মানুষের দ্বারা বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের এই নির্গমনকে আমরা সংক্ষেপে কার্বন নির্গমন বলছি। এই কার্বন নির্গমন ঘটছে মূলত নানা শিল্পের কারখানা থেকে, যানবাহন থেকে, খননকাজ থেকে ও অসংখ্য যন্ত্রনির্ভর নির্মান কাজ থেকে।

আসলে আধুনিক যুগে নানা ক্ষেত্রে কয়লা বা খনিজ তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমানে কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি শহরগুলোতে আবর্জনা পোড়ানো, গ্রামাঞ্চলে ফসলের অবশেষ পোড়ানো, এসব তো আছেই। কার্বন নির্গমন ছাড়াও মানুষের ঘটানো নানান পরিবেশ বিকৃতি নানা ভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখছে।


ভাবার কথা

● পৃথিবীতে কার্বন নির্গমনের হার খুবই উদ্বেগজনক। ২০১৯ সালে এর মোট পরিমাণ ছিলো সুবিপুল ৩৬.৮ বিলিয়ন টন। এটা ২০১৮ সালের থেকে .৬ শতাংশ বেশি। [CarbonBrief]। ২০২০ সালে অতিমারী জনিত অর্থনৈতিক মন্দা সত্বেও বিশ্বে মোট কার্বন নির্গমন কমেছে মাত্র ২.৩ বিলিয়ন টন।

● বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর অনুপাত ইতিমধ্যেই ৪১০ পার্টস পার মিলিয়ন পার হয়ে গেছে। এই অনুপাত গত অন্তত ২ কোটি বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি [Wikipedia]।

● পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোয় সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন হয়। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ-ই ঘটে বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদন ক্ষেত্রে, প্রায় ২০ শতাংশ ঘটে পণ্য উৎপাদন ও পরিকাঠামো নির্মাণ ক্ষেত্রে। আরও প্রায় ২০ শতাংশ ঘটে পরিবহন ক্ষেত্রে [Our World In Data]।

● কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো কার্বন নির্গমন ও পরিবেশ দূষণের একটা বড়ো উৎস। এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশই কয়লা পুড়িয়ে হয়।



কার্বন নির্গমন বিশ্ব উষ্ণায়নের এক বড়ো কারণ

কার্বন নির্গমন থেকে ঘটছে বিশ্ব উষ্ণায়ন

বনধ্বংস ও বিশ্ব উষ্ণায়ন

গাছপালা, বিশেষ করে বনের বৃক্ষরা, বাতাস থেকে প্রচুর CO2 শোষণ করে নিজেদের দেহে আবদ্ধ করে। এইভাবে গাছপালা কার্বন ডুবি হিসেবে কাজ করে। জীবাশ্ম জ্বালানির দহনে বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুতে মিশে যাওয়ার কুফলও হয়তো এড়ানো যেতো। তার জন্য দরকার ছিলো পৃথিবীর বুকে অরণ্যের আচ্ছাদন অনেকখানি বাড়িয়ে নেওয়া।

বাস্তবে অবশ্য এরকম ঘটেনি, বরং উল্টোটাই ঘটেছে। বিগত দুশ বছরের মধ্যে উন্নয়নের নামে সারা পৃথিবীর বনভূমি ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বন কেটে উজাড় করা আজও বন্ধ হয়নি। মানুষের দ্বারা এইভাবে পৃথিবীর বনসম্পদ ব্যাপক আকারে বিনষ্ট হওয়াটাও বিশ্ব উষ্ণায়নের একটা বড়ো কারণ।

নির্বিচার বৃক্ষনিধন বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ

বিশ্ব উষ্ণায়নের বিষময় ফলাফল

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল মানুষের জন্য ঘোর অনিষ্টকর। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, উষ্ণায়নের প্রভাবে বিশ্বের সর্বত্র জলবায়ু পরিবর্তন দেখা দেবে, বাড়বে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা। তাছাড়া পৃথিবীর নানা অংশে চরম আবহাওয়ার বিভিন্ন ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপও অনেক বেড়ে যাবে, যেমন,

  • অনাবৃষ্টি,
  • খরা,
  • তাপপ্রবাহ,
  • ঘূর্ণিঝড়,
  • অতিবৃষ্টি,
  • বন্যা,
  • শৈতপ্রবাহ,
  • দাবানল, ইত্যাদি।

একই সাথে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল স্বরূপ মেরু অঞ্চল ও পার্বত্য হিমবাহগুলোর বরফের গলন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। বিপুল পরিমান বরফগলা জলে সাগর মহাসাগরগুলো ফুলে ফেঁপে উঠবে। এ থেকে বহু উপকূলীয় এলাকা ও দ্বীপ চিরতরে সমুদ্রের গর্ভে তলিয়ে যাবে।

জীবজগতের ওপরে বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরাট প্রভাব পড়তে চলেছে। বিজ্ঞানীরা সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অচিরেই জলে ও ডাঙায় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে দেবে। জীব বৈচিত্রের অপূরণীয় ক্ষয় তো হবেই, মানুষের জন্যও এর পরিণতি ভালো হবে না। কারণ,—

➤বিশ্ব উষ্ণায়ন জনিত নতুন পরিবেশে কমে যাবে মানুষের বন্ধু উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা।

➤উষ্ণায়নের সুযোগে দ্রুত মাথা চাড়া দেবে নানান ক্ষতিকর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু, পোকামাকড় ও অন্য অনেক বিপজ্জনক জীবজন্তু।

➤সারা পৃথিবীতে প্রবল হয়ে উঠবে নানান প্রাণঘাতী রোগ।

➤কৃষিক্ষেত্রেও ঘটবে বিপর্যয়।

➤দেখা দেবে খাদ্যাভাব, যা থেকে ঘনিয়ে উঠতে পারে বিশ্বব্যাপী ঘোরতর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট।

এর মধ্যেই কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের ভয়ংকর ফল বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। অতএব এখনি সাবধান হওয়া দরকার! এখনই পৃথিবীর সব দেশ মিলে বিশ্ব উষ্ণায়নে রাশ টানা দরকার। পৃথিবীতে মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে চাইলে এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রতিকার কোন পথে

আমরা যদি বিশ্ব উষ্ণায়নে রাশ টানতে চাই তাহলে শিল্প ও পরিবহন সহ সমস্ত ক্ষেত্রে কয়লা বা খনিজ তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আমাদের কমাতেই হবে। তাছাড়া পরিবেশ দূষণও আমাদের পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।

আসলে বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে মুক্তি চাইলে আমাদের জোর দিতে হবে সৌর ও বায়ু শক্তির মতো পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ওপর। পাশাপাশি কার্বন নির্গমন তথা বায়ু দূষণ কম হয় এমন উন্নততর প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো দরকার।

তবে বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিকারে যেটা সবচেয়ে জরুরি কথা সেটা হলো, গাছপালা বাঁচাতে হবে বনজঙ্গল বাঁচাতে হবে। ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে, পৃথিবীকে আবার সবুজে ভরিয়ে তুলতে হবে। বিশ্ব উষ্ণায়ন রুখতে এগুলো এখন সময়ের জরুরি দাবি। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]