প্রকৃতি ধ্বংসের পরিণামে ব্যাধির বিপদ বাড়ছে

প্রকৃতি ধ্বংসের পরিণামেই বাড়ছে ব্যাধির বিপদ

করোনা ভাইরাস ঘটিত অতিমারির মধ্যেই কয়েকজন বিজ্ঞানী শুনিয়েছেন এক বিশেষ সাবধানবাণী। মানুষের জন্য ব্যাধির অভিশাপ এখানেই শেষ নয়। অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে দেখা দিতে পারে আরো নতুন নতুন রোগ। এই দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ি অবশ্য মানুষেরই নানা ধ্বংসাত্মক কাজ। এই সব হঠকারি কাজ বন্ধ করে প্রকৃতি-কেন্দ্রিক ভাবধারা গ্রহণ করার জন্য পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আজ বিশ্ব মানবকে আহ্বান জানাচ্ছেন।

ভয় ধরাচ্ছে ভাইরাস

কীভাবে মানুষের নানা ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিপজ্জনক রোগব্যাধি মাথা চাড়া দিচ্ছে, সেটা বিজ্ঞানীরা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথমেই বন্যপ্রাণীদের থেকে মানুষের মধ্যে চলে আসা অচেনা ভাইরাসগুলোর প্রতি তারা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রকৃতির রাজ্যে নানান জীবজন্তুর শরীরে এরকম লক্ষ কোটি ভাইরাস বাসা বেঁধে আছে। বন্য প্রাণীদের মেরে মাংস খাওয়ার সময় এগুলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অন্য কোনো ভাবে বনের পশুপাখির ছোঁয়াচ লাগলেও এই একই ঘটনা ঘটতে পারে।

আসলে অনেক ভাইরাসই মানুষ ও অন্য প্রাণীদের মধ্যে সীমারেখা মানে না। এগুলো সহজেই প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে ঢুকে পড়তে সক্ষম। জীববিজ্ঞানে এ ধরণের ভাইরাসকে বলা হয় জুনোটিক ভাইরাস (Zoonotic Virus)। প্লেগ বা জলাতঙ্কের মতো কিছু কিছু জুনোটিক ভাইরাসের সাথে মানুষ আদিম কাল থেকেই পরিচিত। কিন্তু বেশির ভাগ জুনোটিক ভাইরাস আজো পর্যন্ত মানুষের অজানাই থেকে গেছে। এই অজানা ভাইরাসগুলোই ক্রমশ হয়ে উঠছে বড়ো আশঙ্কার কারণ।

অ-সুখের খতিয়ান
গবেষকরা জানাচ্ছেন, ১৯৬০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ টা নতুন ভাইরাস ঘটিত রোগ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে। এই তালিকায় আছে এইচআইভি এইডস, লাস্সা ফিভার, জিকা, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, নিপা, সার্স, মার্স ও ইবোলার মতো বিপজ্জনক রোগ। নতুন ভাইরাসগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি বন্যপ্রাণীদের জগৎ থেকে মানুষের মধ্যে চলে এসেছে। এই প্রবণতা এখানেই থেমে থাকবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

সাম্প্রতিক মহামারি: সার্স, মার্স, কভিড

২০০২-০৩ সালে চিনে দেখা গিয়েছিলো সার্স (SARS, Severe Acute Respiratory Syndrome) ভাইরাসের মহামারি। সার্স ছিলো জুনোটিক ভাইরাস। অনুমান করা হয়, এক ধরনের বুনো ভামের মাংস থেকে এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ২০১২ সালে মধ্য এশিয়ায় মহামারি ঘটিয়েছিলো মার্স (MERS, Middle East Respiratory Syndrome) ভাইরাস। সেবারে এক জাতীয় উটের মাংস থেকে এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি যে নোভেল করোনা ভাইরাস (Novel Corona Virus) সারা পৃথিবীতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে সেটাও আদতে জুনোটিক ভাইরাস। বিজ্ঞানীদের অনুমান, চিন দেশের উহান শহরে বন্যপ্রাণী মাংসের এক খোলাবাজার থেকে এই ভাইরাসটা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

কী কারণে নিত্য নতুন ভাইরাসের উপদ্রব?

বন্যপ্রাণ বিনাশের প্রতিফল

বনের প্রাণীদের ধরা, মারা ও তাদের মাংস খাওয়ার চল চিন দেশে খুব বেশি। এছাড়াও এশিয়া-আফ্রিকার আরো অনেক দেশে এর চল আছে। অনেক দেশেই খোলা বাজারে নোংরা পরিবেশে বনের পশুপাখির মাংস বিক্রি হয়। বুনো জীবজন্তুর চামড়া, ফার, দাঁত, নখ, খড়্গ, হাড়, শিং, এসবের ব্যবসা সারা বিশ্বেই চলে রমরমিয়ে। আবার বনের নিরীহ পশুপাখিদের ধরে এনে চিড়িয়াখানার খাঁচায় কয়েদ করে রাখাটা সব দেশেই মানুষের একটা নিষ্ঠুর শখ। এইভাবে বন্যপ্রাণের ক্ষতি সাধন চালিয়ে গেলে মানুষের মধ্যে নতুন নতুন জুনোটিক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াটা কেবল সময়ের অপেক্ষা।

অরণ্য ধ্বংসের পরিণতি

শুধু বন্য প্রাণীদের মাংস খাওয়া থেকেই নতুন রোগ ছড়াতে পারে, এমন মোটেই নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বন জঙ্গল কেটে সাফ করে দেওয়ার ফলেও দেখা দিতে পারে নতুন বিপদ। বাস্তবেই এর প্রমাণ আমরা দেখছি। খনি, বাঁধ, কারখানা, রাস্তা বা রেলপথ তৈরি কিংবা কাঠ সরবরাহের জন্য মানুষ যতো বেশি বনসম্পদ ধ্বংস করছে, ততোই বনের অন্দরমহলে থাকা বিপজ্জনক ভাইরাস ও জীবাণুর দল চলে আসছে লোকালয়ে। দেখা দিচ্ছে নিত্য নতুন রোগ। মারা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাদের জীবনের বিনিময়েই অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাম চোকাতে হচ্ছে।

বিজ্ঞানী ডেভিড কোয়াম্মেন তার একটি বইয়ে (‘Spillover: Animal Infection and the Next Human Pandemic’) খুব সুন্দরভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন। তার কথায়:

“আমরা (মানুষেরা) নিরক্ষীয় অরণ্য এবং অন্যান্য বনজঙ্গলে আগ্রাসন চালাচ্ছি যেগুলো অজস্র প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতিতে ভরা। এইসব জীবের দেহের মধ্যে আবার রয়েছে অসংখ্য ভাইরাস ও জীবাণু। আমরা গাছপালা কেটে ফেলছি, প্রাণীদের মেরে ফেলছি অথবা খাঁচায় বন্দী করে তাদেরকে বাজারে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এইভাবে আমরা বাস্তুতন্ত্রে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি ও সেখানকার ভাইরাসদেরকে তাদের স্বাভাবিক পোষকদের থেকে বের করে ছড়িয়ে দিচ্ছি। যখন এরকম ঘটে, ঐ ভাইরাসদের নতুন পোষক খুঁজে নেবার দরকার হয়ে পড়ে, প্রায়শ আমরা নিজেরাই তাদের নতুন পোষকে পরিণত হয়ে পড়ছি।”

অরণ্য সম্পদ ধ্বংস

পরিবেশের নানা পরিবর্তনে বিপদ বাড়ছে

বনজঙ্গল কেটে কৃষিজমি বাড়ানো, বাগিচা পত্তন ও নগরায়ণ যতো ঘটছে ততোই ইঁদুর, মশা বা মাছির মতো কিছু কিছু প্রাণী দ্রুত বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ পাচ্ছে। এই প্রাণীগুলো মানুষের মধ্যে রোগ ছড়ানোর ব্যাপারে সুপরিচিত।

মানব-সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ আবার মানুষের নিজেরই রোগ প্রতিরোধ শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেব আছে অস্বাস্থ্যকর জীবনশৈলি ঘটিত নানান বিকৃতি। অন্যদিকে শহরগুলোর অতি ঘন জনবসতি সংক্রামক রোগগুলোকে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করছে।

সব মিলিয়ে দেখলে, প্রকৃতির অতিরিক্ত বিরোধিতা করতে গিয়ে ও পরিবেশ দূষিত করে আমরা, মানুষেরা, নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মারছি।

এভাবেই চলছে প্রকৃতি ধ্বংসের হঠকারিতা

প্রকৃতির সংরক্ষণ ছাড়া বাঁচার উপায় নেই

একটু খেয়াল করলেই একটা জিনিস বোঝা যায়। নতুন ভাইরাসগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আগেরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে ও অনেক তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলো আবার দ্রুত মিউটেশন বা চরিত্রবদল করে তৈরি করছে নতুন নতুন ধরণ। ফলে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও আর সহজে এগুলোকে সামাল দিতে পারছে না। প্রকৃতি-বিরোধী ও পরিবেশ-ধ্বংসকারী কাজকর্ম চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এধরনের আরো নতুন নতুন ভাইরাস ও জীবাণু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ঘটতে পারে আরো অনেক মহামারি। এমনটাই বলছেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীরা সাবধান করেই চলেছেন। তারা বারবার বলছেন, প্রকৃতির সংরক্ষণ ছাড়া মানুষ এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু তার পরেও কি আমরা সচেতন হচ্ছি? প্রশ্নটা থাকছেই। [কৃতজ্ঞতা স্বীকার: The Guardian[ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]