মাটির কলসি আজও, প্রযুক্তির এই চরম উন্নতির যুগেও, বাংলার জনজীবনের অঙ্গ। বিশেষ করে গরমের দিনে ঠান্ডা জল খেতে চাইলে মাটির কলসি তুলনাহীন। স্বাস্থ্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে ফ্রিজের জলকে হাসতে হাসতে দশ গোলে হারিয়ে দেবে মাটির কলসির ঠান্ডা জল।
মাটির কলসির গুণ
অনেকে মাটির কলসিকে বলেন মটকা। আকার আকৃতি অনুসারে নানা ধরনের মাটির কলসির নানান স্থানীয় নামও আছে। ধাতু ও প্লাস্টিকের বহুল প্রচলনের ফলে আজকাল সব রকম মাটির পাত্রেরই ব্যবহার খানিকটা কমে গেছে। তবু কিছু ব্যাপারে বিশেষ উপকারিতা থাকায় আজও কয়েক ধরনের মাটির পাত্র স্বমহিমায় বিরাজমান। জল ঠান্ডা রাখার মাটির কলসি তার মধ্যে একটা।
মাটির কলসির জল ঠান্ডা থাকে কেনো?
কুমোরেরা মাটির কলসি তৈরির সময় এঁটেল মাটির সাথে নির্দিষ্ট পরিমানে মিহি বালি বা বেলে মাটি মেশান। ফলে এধরনের কলসির গায়ে থাকে অসংখ্য সূক্ষ্ম ছিদ্র। মাটির কলসিতে জল রাখলে ঐ ছিদ্র দিয়ে জল বাষ্পীভূত হতে থাকে। বাষ্পীভবন-এর ফলে খানিকটা লীন তাপ কলসির জল থেকে বেরিয়ে যায়। সাধারণ ভাবে ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় প্রতি গ্রাম জলের বাষ্পীভবনের ফলে ৫৭৭.৫ ক্যালোরি তাপ কলসি থেকে বেরিয়ে যায়। এই কারণে মাটির কলসিতে জল রাখলে সেই জল থাকে ঠান্ডা, সুপেয়।
ফ্রিজের জল বনাম মাটির কলসির জল
মাটির কলসির জল ঠান্ডা হলেও তা অতিরিক্ত ঠান্ডা নয়, ঈষৎ ঠান্ডা। এই ঠান্ডা আমাদের শরীরের পক্ষে সহনীয়। তুলনায় ফ্রিজের জল অনেক বেশি ঠান্ডা। সাধারণত ফ্রিজ থেকে বের করার সময় এর তাপমাত্রা থাকে ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড যা পরিবেশের তাপমাত্রার চেয়ে অনেক কম। এই জল আমাদের শরীরের পক্ষে নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর।
ফ্রিজের ঠান্ডা জল সরাসরি খাওয়া মানে গলা ও শ্বাসতন্ত্রে ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণকে যেচে আমন্ত্রণ জানানো। এই জল পাকস্থলীর হজমশক্তিকেও ব্যাহত করে। এটা আমাদের শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ শক্তির পক্ষে প্রতিকূল। তুলনায় মাটির কলসির জল অল্প ঠান্ডা হওয়ায়, এধরনের কোনো অপকারিতা এর নেই। বরং মাটির কলসির জলের উপকারিতা এই যে এটা ঈষৎ ক্ষারীয় হওয়ায় রক্তের অতিরিক্ত অম্লতা দূর করতে সাহায্য করে।
এক নিরাপদ জলপাত্র
মাটির কলসির উপকারিতা সম্পর্কে আরো একটা কথা বিশেষ ভাবে বলা দরকার। ফ্রিজে জল রাখার কাজে আমরা প্রায়শই ব্যবহার করি প্লাস্টিক বোতল। এই সব প্লাস্টিক বোতল থেকে বিসফেনল জাতীয় ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পানীয় জলে মিশে যাওয়ার একটা ভয় থেকেই যায়। এদিক থেকে মাটির কলসি জল রাখার কাজে অনেক নিরাপদ। কারণ, মাটির কলসিতে জল রাখলে জলে কোনো রকম অপকারী রাসায়নিক পদার্থ মিশে যাওয়ার ভয় নেই।
মৃৎপাত্র নির্মাণ
প্রাণ জুড়ানো জলের ম্যাজিক
গরমের দিনে মাটির কলসির ঠান্ডা জল খেলে শরীরে স্বস্তি মেলে। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তাছাড়া মাটির কলসির জলে তৈরি করা যায় নানা রকম মন মাতানো শরবত। যেমন,—
- লেবুর শরবত
- দইয়ের ঘোল
- আমের শরবত
- বেলের শরবত
- তেঁতুলের শরবত
- কামরাঙার শরবত
- পুদিনার শরবত
- ফলসার শরবত, আরো কতো কি!
মাটির কলসির যত্নআত্তি
বাড়িতে মাটির কলসি রাখলে একটা বিষয়ে একটু খেয়াল রাখতে হবে, কোথাও যেনো জোরে ঠোকা না লাগে। মাটির জিনিস তো, জোরে ঠোকা লাগলে ভেঙে যেতে পারে। তাছাড়া, সপ্তাহে দুবার মাটির কলসি পরিষ্কার করা দরকার।
মাটির কলসি পরিষ্কার করতে কোনো রকম সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করার দরকার হয় না। কলসির ভেতরটা ভালো করে ধুয়ে একটা পরিষ্কার ভেজা কাপড় নিংড়ে মুছে নিতে হবে। এরপর কলসিটা কিছুক্ষণ উপুড় করে রেখে দিয়ে পুরোপুরি শুকিয়ে নিতে হবে। ব্যাস্। আমাদের পুরোনো বন্ধু মাটির কলসির জন্য কেবল এইটুকু যত্নই যথেষ্ট। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]