অ্যাক্সোলটল | প্রাণীজগতের এক অনন্য প্রতিভা

আশ্চর্য প্রাণী অ্যাক্সোলটল

বিস্ময়কর প্রাণী ও উদ্ভিদে পরিপূর্ণ আমাদের পৃথিবী। এমনই এক অদ্ভুত প্রাণী হলো অ্যাক্সোলটল। দেহের কোনো অঙ্গ কাটা পড়লে এই প্রাণী খুব সহজেই সেটা আবার গজিয়ে নিতে পারে। এই আশ্চর্য প্রাণীটি ‘মেক্সিকোর চলন্ত মাছ’ নামেও পরিচিত। যদিও এটি আসলে মাছ নয়, বরং ব্যাঙের মতো উভচর প্রাণী। প্রজাতিগত ভাবে এটি টাইগার স্যালামান্ডারের সাথে সম্পর্কিত। একসময় মধ্য আমেরিকায় মেক্সিকো উপত্যকার হৃদগুলোতে হাজার হাজার অ্যাক্সোলটল দেখতে পাওয়া যেতো।

অ্যাক্সোলটল: প্রাণী পরিচয়

স্যালামান্ডার জাতীয় প্রাণী অ্যাক্সোলটল, এর বৈজ্ঞানিক নাম Ambystoma mexicanum। সুদৃশ্য এই প্রাণীটির বৈশিষ্ট্য চওড়া মাথা, পাতাবিহীন চোখ, তিন জোড়া বহিঃফুলকা, দেহের সামনে ও পেছনে দুটো করে পা এবং লম্বা লেজ। পূর্ণবয়স্ক অ্যাক্সোলটলের দৈর্ঘ্য ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি হতে পারে। তবে ৯ ইঞ্চির কাছাকাছি দৈর্ঘ্যই বেশি দেখতে পাওয়া যায়। অনুকূল অবস্থায় প্রাণীটি প্রায় ১৫ বছর বেঁচে থাকতে পারে।

২০১৮ সালে বিজ্ঞানীরা অ্যাক্সোলটল জিনোমের ক্রম প্রকাশ করেছেন। ৩২০০ কোটি বুনিয়াদী জোড় যুক্ত এই জিনোম মানুষের জিনোমের থেকে ১০ গুণেরও বেশি বড়ো। প্রাণীটির এই জিনোম ২৩২৫১ টা প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম (মানুষের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা প্রায় ২০০০০)।

রঙ

প্রাকৃতিক পরিবেশে যে অ্যাক্সোলটল দেখা যায় তার রঙ সাধারণত জলপাইয়ের ছোঁয়াযুক্ত বাদামী বা ট্যান। এর ওপরে থাকে সুদৃশ্য সোনালি ডোরা। তবে রঞ্জক জিনের মিউটেশন ও সংকরায়নের ফলে অন্যান্য রঙের অ্যাক্সোলটলও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন,— হালকা গোলাপী, সোনালি, ধূসর, সাদা ও কালো। লুকানোর জন্য প্রাণীটি গায়ের রঙ সীমিতভাবে পরিবর্তনও করতে পারে।

খাদ্য

অ্যাক্সোলটল প্রধানত আমিশাষি প্রাণী। এরা সাধারণত গন্ধের সাহায্যে খাদ্য বস্তুকে চিহ্নিত করে ও মুখে নিয়ে গিলে খায়। এদের খাদ্য তালিকায় আছে—

  • ছোটো ছোটো মাছ,
  • পোকামাকড়,
  • নানারকম ওয়র্ম,
  • বিভিন্ন প্রাণীর লার্ভা,
  • শামুক জাতীয় প্রাণী, ইত্যাদি।

বেঁচে থাকার বিচিত্র কৌশল নিওটেনি

অন্যান্য উভচর প্রাণীর মতো লার্ভা দশা থেকে পরিণত দশায় পৌঁছানোর সময় অ্যাক্সোলটলের দেহের রূপান্তর বা মেটামরফোসিস হয় না। জীব বিজ্ঞানে এই ঘটনাকে বলা হয় নিওটেনি। এর জন্য দায়ি আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড গ্রন্থির বিকাশ না হওয়া। আসলে এটা অ্যাক্সোলটলের বেঁচে থাকার এক বিশেষ কৌশল।

প্রাকৃতিকভাবে অ্যাক্সোলটল যে পরিবেশে বাস করে সেখানকার খাদ্যে আয়োডিন অপ্রতুল। তাই নিওটেনির মাধ্যমে এই প্রাণী শৈশবকালীন বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় রেখেই পরিণত ও প্রজনন সক্ষম হয়ে ওঠে। উভচর হওয়া সত্ত্বেও এর দেহে কখনোই সুগঠিত ফুসফুস তৈরি হয় না এবং এটি আজীবন জলেই কাটিয়ে দেয়। অবশ্য পরীক্ষাগারে কৃত্তিম ভাবে আয়োডিন প্রয়োগ করে অ্যাক্সোলটলের দৈহিক রূপান্তর ঘটানো সম্ভব।

অ্যাক্সোলটল প্রাণীজগতের এক বিস্ময়

অ্যাক্সোলটলের নষ্ট অঙ্গ পুনরুৎপাদন ক্ষমতা

যে অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার জন্য অ্যাক্সোলটল বিশ্ব বিখ্যাত সেটা হলো নষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পুনরুৎপাদন। দেহের যে কোনো অংশ, যেমন, লেজ, পা, চোখের টিস্যু, ইত্যাদি কোনোভাবে কাটা গেলে বা নষ্ট হলে, এই প্রাণী খুব সহজেই সেটা আবার গজিয়ে নিতে পারে। এমনকি, ফুসফুস, হৃৎপিন্ড, মেরুদন্ড ও মস্তিষ্কের কোনো কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রাণীটি তা পুনরুৎপাদন করে নিতে সক্ষম।

অ্যাক্সোলটল ছাড়া অন্য কোনো মেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে নষ্ট অঙ্গ পুনরুৎপাদনের এতোটা ক্ষমতা দেখতে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্রাণীটির এই সুপার পাওয়ারের মূলে আছে এর দেহে এক বিশেষ ধরনের ফাইব্রোব্লাস্ট কোষের উপস্থিতি।

অনন্য অ্যাক্সোলটলের বিপন্নতা

অ্যাকোয়ারিয়ামের পোষ্য প্রাণী হিসেবে সারা বিশ্বেই অ্যাক্সোলটল জনপ্রিয়। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজনে বহু জায়গায় পরীক্ষাগারে এই প্রাণীটিকে পালন করা হয়। তবে নিজের আদি নিবাসেই প্রাণী জগতের এই মহান প্রতিভা আজ অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি।

এক সময় মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো উপত্যকায় ক্সচিমিলকো ও চ্যালকো হৃদের মতো হৃদগুলোতে প্রচুর সংখ্যায় অ্যাক্সোলটল দেখতে পাওয়া যেতো। নগরায়ন ও শিল্পায়নের চাপে এই হৃদগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা আজ ইতিহাস। বাকিগুলোর জল অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে পড়েছে দূষিত। তার ওপরে স্থানীয় জলাশয়গুলোতে মাছচাষের জন্য ছাড়া হয়েছে আফ্রিকান তিলাপিয়া ও এশিয়ান কার্পের মতো নানা বিদেশি মাছ, যারা অ্যাক্সোলটলের ছানাপোনাদের খেয়ে ফেলছে।

সব মিলিয়ে প্রাণীজগতের বিস্ময় অ্যাক্সোলটল আজ নিজের স্বাভাবিক বাসভূমিতে গভীর সংকটের মুখোমুখি। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন (International Union for Conservation of Nature, IUCN) ইতিমধ্যেই অ্যাক্সোলটলকে অতিবিপন্ন প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করে প্রাকৃতিক পরিবেশে এটির সংরক্ষণের জন্য আবেদন জানিয়েছে। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]