বাড়ির আবর্জনাকে কম্পোস্ট সার তৈরির কাজে লাগান

গাছেদের পক্ষে কম্পোস্ট সারের উপকারিতা অতুলনীয়।

রান্নাঘরের সবজির খোসাগুলোকে আপনি কি বাজে আবর্জনা মনে করে ফেলে দেন? কিম্বা বাতিল কাগজের টুকরোগুলোকে ফালতু জঞ্জাল ভেবে পাঠিয়ে দেন ডাস্টবিনে? এমন ভুল কাজ কখ্খনো করবেন না! ওগুলো মোটেই ফালতু জিনিস নয়। ওগুলোকে আপনি সহজেই কম্পোস্ট সার তৈরির কাজে লাগাতে পারেন। সেই সার হবে আপনার বাগানের ও টবের গাছেদের জন্য পুষ্টিকর খাবার। অতএব আর দেরি না করে, আসুন, বাড়ির আবর্জনা থেকে কম্পোস্ট সার তৈরির পদ্ধতি জেনে নিন।

বাগানের কালো সোনা কম্পোস্ট

কম্পোস্ট সার কাকে বলে? উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহ জাত আবর্জনা থেকে বিভিন্ন অনুজীবের ক্রিয়ার ফলে জৈব পদ্ধতি-তে কালচে রঙের, ঝুরঝুরে, মাটির মতো যে পদার্থ তৈরি হয় তাকেই বলে কম্পোস্ট (compost) সার। নাইট্রোজেন ও কার্বন ছাড়াও নানান অনুখাদ্য (micronutrient) যুক্ত এই সারের উপকারিতা ফল, ফুল বা সবজি গাছের পক্ষে অতুলনীয়। কম্পোস্ট সার প্রয়োগে যে কোনো গাছের বাড় যেমন বেশি হয়, ফলনও হয় তেমনই দুর্দান্ত। রসিক জনেরা তাই ভালোবেসে এর নাম দিয়েছেন বাগানের কালো সোনা

কম্পোস্ট সারের উপকারিতা

উত্তম জৈব সার কম্পোস্ট। বাগানে বা টবে এই সার প্রয়োগ করলে মাটি সমৃদ্ধ হয়, মাটির উর্বরতা বাড়ে। এই সার মাটির জল ধরে রাখার ক্ষমতা অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও কম্পোস্ট সারের আরো অনেক উপকারিতা আছে। এই সার—

  • মাটিকে ঝুরঝুরে কোরে বায়ুচলাচল বাড়ায়।
  • মাটিতে উপকারি অনুজীবদের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করে।
  • মাটির আম্লিকতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
  • ভূমিক্ষয় রোধে সাহায্য করে। এবং এছাড়াও
  • মাটির ওপরে দিলে মালচিং বা আচ্ছাদনের এর কাজ করে।

বাড়িতে কম্পোস্ট সার তৈরির পদ্ধতি

কম্পোস্ট সার তৈরির জায়গা

বাগানের এক কোণায় অগভীর গর্ত খুঁড়ে সেখানে বাড়ির পরিত্যক্ত জৈব আবর্জনাগুলো জমিয়ে আপনি কম্পোস্ট সার তৈরি করতে পারেন। তবে কম্পোস্ট বিন ব্যবহার করে কাজটা করলে আপনার সুবিধা হতে পারে। ধাতু বা প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন মডেলের কম্পোস্ট বিন বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। জৈব আবর্জনাগুলো জমানোর জন্য একটু মাথা খাটিয়ে কাঠের বা প্লাস্টিকের কম্পোস্ট বিন আপনি নিজেও তৈরি করে নিতে পারেন। বিন কেনা হোক বা নিজে তৈরি করা হোক, আপনাকে দেখতে হবে যাতে সেটায় হাওয়া চলাচলের জন্য চারপাশে যথেষ্ট ছিদ্র বা ব্যবস্থা থাকে।

ঘরে তৈরি কম্পোস্ট সার তৈরির বিন

ঘরে তৈরি প্লাস্টিকের কম্পোস্ট বিন

কমপোস্ট সার তৈরির উপাদান

কম্পোস্টিং-এ কী কী কাজে লাগানো যাবে?

গর্ত কিম্বা বিন, আপনি যেখানেই কম্পোস্টিং করুন, সার তৈরির পদ্ধতিতে কোন কোন আবর্জনা কাজে লাগানো যাবে আর কোন কোন আবর্জনা কাজে লাগানো যাবে না, সেটা আগে জেনে নেওয়া দরকার। কম্পোস্ট সার তৈরির পদ্ধতি হলো এক জৈব পদ্ধতি। এতে মূল উপাদানগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, সবুজবাদামি। সবুজের উদাহরণ: সবজির খোসা, ফলমূলের ছাল, বাগানের সবুজ ঘাসপাতা, আগাছা, ইত্যাদি। বাদামির দলে পড়ে: গাছের শুকনো পাতা ও ছোটো ছোটো ডালপালা, কাগজ কুচি, কার্ডবোর্ডের টুকরো, খড়, শুকনো চাপাতা, এইসব। সবুজ ও বাদামি ছাড়াও কম্পোস্ট সার তৈরির পদ্ধতিতে আরেক ধরণের উপাদান যোগ করা যায়। সেটা হলো সাদা, অর্থাৎ, ডিমের খোলা।

কম্পোস্ট সার তৈরির সবুজ উপাদানগুলোতে নাইট্রোজেন বেশি থাকে। বাদামিগুলো সারে জোগায় বাড়তি কার্বন। বাদামি উপাদানগুলোর আরেকটা উপকারিতা হলো এগুলো কম্পোস্টিং এর সময় দুর্গন্ধ দূর করতেও সাহায্য করে। সাদা উপাদান ডিমের খোলা থেকে কম্পোস্ট সারে আসে প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম। কম্পোস্ট সার তৈরির পদ্ধতিতে সবুজ ও বাদামি উপাদানগুলো ওজন অনুসারে ২:১ অনুপাতে মেশাতে পারলে ভালো হয়। তবে এই অনুপাতের কিছুটা কমবেশি হলেও কম্পোস্টিং-এ বিরাট কিছু অসুবিধা হয় না।

কম্পোস্টিং-এ কী কী কাজে লাগানো যাবে না

ঘরোয়া ভাবে কম্পোস্ট সার তৈরির পদ্ধতিতে মাছের কাঁটা, মাংসের হাড়, মাছের বা মাংসের টুকরো, ডিমের ভেতরের তরল অংশ, দুধের তৈরি জিনিস বা অন্য কোনো প্রাণীজ অবশেষ ব্যবহার না করাই ভালো। এগুলো পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে পারে। তাছাড়া এগুলো থেকে রোগব্যাধি ছড়ানোর ভয় থাকে। একই কারণে কুকর, বেড়াল বা অন্য কোনো মাংসাশি প্রাণীর বর্জ্যও কম্পোস্ট সার তৈরির কাজে লাগানো ঠিক নয়। তবে বিভিন্ন শাকাহারি প্রাণী, যেমন, গরু, ছাগল বা ভেড়ার বর্জ্য কম্পোস্ট সার তৈরির মিশ্রণে যোগ করতে কোনো অসুবিধা নেই। এতে বরং উৎপন্ন সারের মান উন্নত হবে।

কীটনাশক বা অন্য কোনো কৃষিবিষ যুক্ত কোনো উদ্ভিজ্জ বা প্রাণীজ অবশেষ কম্পোস্ট সার তৈরির পদ্ধতিতে একেবারেই ব্যবহার করা চলবে না। প্লাস্টিক বা কোনো রকম ‘নন-বায়োডিগ্রেডেবল’ আবর্জনা, যেগুলো সহজে পরিবেশে মিশে যায় না, সেগুলো যাতে কম্পোস্ট সার তৈরির মিশ্রণে চলে না যায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।

কম্পোস্টিং

বাড়ির জৈব আবর্জনা কম্পোস্টিং করে সার তৈরি

জল

কম্পোস্টিং প্রক্রিয়ায় জৈব উপাদানগুলোর সাথে মাঝেমাঝে পরিমিত জল মেশানো দরকার। এটা এমন ভাবে করতে হবে যাতে কম্পোস্ট সার তৈরির আবর্জনা গাদায় সবসময় ভেজা ভেজা ভাব থাকে, কিন্তু সেটা ভিজে একেবারে চুপচুপে না হয়ে যায়।

বায়ু

ঘরোয়া কম্পোস্টিং এর ক্ষেত্রে সার তৈরির মিশ্রণটাকে যথেষ্ট 'হাওয়া খাওয়ানো'র ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। এ জন্য, গর্তে কম্পোস্ট বানালে, সপ্তাহে অন্তত একদিন গর্তের মিশ্রণটাকে কোদাল বা বেলচা দিয়ে ঘেঁটে দিতে হবে। কম্পোস্ট বিন ব্যবহার করলে দুএক দিন বাদে বাদে বিনটাকে ভালো করে ঝাঁকিয়ে দিতে হবে। কম্পোস্টিং এর সময় সার তৈরির মিশ্রণের সব অংশে ঠিকঠাক বাতাস পৌঁছালে সেটা থেকে দুর্গন্ধ বেরোবে না। উৎপন্ন সারের মানও ভালো হবে। কম্পোস্ট সার তৈরির এই পদ্ধতি সবাত বা aerobic পদ্ধতি নামে পরিচিত।

অন্যান্য

কম্পোস্ট সার তৈরিতে জৈব আবর্জনাগুলোর সাথে মাঝে মাঝে অল্প পরিমানে বাগানের মাটি যোগ করা যেতে পারে। এর উপকারিতা হলো এতে কম্পোস্টিং প্রক্রিয়ায় কিছুটা গতি আসবে। এছাড়া, কখনো যদি আপনার মনে হয়, কম্পোস্ট সার তৈরির মিশ্রণ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে, তবে কিছুটা বাদামি উপাদান, যেমন, কাগজের কুচি, কার্ডবোর্ডের টুকরো, খড় বা শুকনো পাতা দিয়ে ওই মিশ্রণটা ঢেকে দেবেন। এতে গন্ধ ছড়ানো বন্ধ হবে।

মনে রাখার বিষয়

বাড়ির জৈব আবর্জনার মিশ্রণ পুরোপুরি পচে সারে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত সেটা গাছে দেওয়া চলবে না। দিলে কিন্তু গাছের ক্ষতি হতে পারে। জৈব আবর্জনার মিশ্রণ থেকে কম্পোস্ট সার তৈরি হতে কম করে তিন/চার মাস সময় লাগতে পারে। এর জন্য এমনকি বছর খানেকও সময় লেগে যেতে পারে। কম্পোস্টিং মিশ্রণ সার হিসেবে ব্যবহারের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়েছে কিনা তা দেখেই বোঝা যাবে। সার হয়ে গেলে তার রঙ হবে কালচে বা গাঢ় বাদামি, গঠন হবে ঝুরঝুরে এবং গন্ধ হবে ঠিক মাটির মতো।

সব শেষে আর একটা জরুরি কথা। কোনো কিছুরই 'অতি' ভালো নয়। বাগানের কালো সোনা কম্পোস্ট সারের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। যে কোনো জায়গায় মাটির উর্বরতা বুঝে গাছে যতোটা দরকার ততোটাই কম্পোস্ট সার দিতে হবে। পরিমিত সার প্রয়োগেই আপনার বাগানের বা টবের গাছগুলো ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠবে। বাড়তি সার দেওয়ার কোনো দরকারই হবে না। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]