শাশ্বত কল্যাণের অজস্র উপকরণে পরিপূর্ণ এই বিশ্ব প্রকৃতি। মধু তারই এক অমূল্য উপহার। অসাধারণ পুষ্টিগুণে ভরা মধুর উপকারিতা অতুলনীয়। খাঁটি মধুর একটা আশ্চর্য গুণ আছে। বছরের পর বছর রেখে দিলেও এটা কখনো নষ্ট হয় না। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মিশরের প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে মধুর এমন নমুনা পেয়েছেন যার বয়স ৩০০০ বছর। সেই মধুতে আজও কোনো বিকার আসেনি। প্রকৃতপক্ষে খাঁটি মধু হলো পৃথিবীর একমাত্র খাদ্যবস্তু যার সেই অর্থে কোনো এক্সপায়ারি ডেট হয় না।
মধুর মধ্যে থাকে গ্লুকোনিক অ্যাসিড ও হাইড্রোজেন পারক্সাইড সহ নানান জীবাণুরোধী যৌগ। তাই এতে ব্যাক্টেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীব বাসা বাঁধতে পারে না। এই কারণেই খাঁটি মধু এতো দীর্ঘস্থায়ী হয়। মধু ছাড়া আর কোনো খাদ্যের এতোটা জীবাণু-প্রতিরোধী গুণ নেই। |
মধুর পুষ্টি উপাদান
শুনলে অবাক লাগতে পারে, সুপারফুড মধু আসলে মৌমাছিদের এক ধরনের বমি। মধু কীভাবে তৈরি হয় জানেন? মৌচাকের শ্রমিক মৌমাছিরা ফুলে ফুলে উড়ে মিষ্টি রস সংগ্রহ করে তাদের মধু-পাকস্থলীতে জমা করে। মৌচাকে ফিরে তারা সেই রস উগরে দেয় চাকে থাকা অন্যান্য শ্রমিকদের মুখে। চাকের শ্রমিকরা সেই রস মধু-কুঠুরিতে সঞ্চয় করে। এই ভাবে ফুলের রসের সাথে মৌমাছিদের মুখের ও পাকস্থলীর নানান উৎসেচক মিলেমিশে তৈরি হয় মধু। মৌচাকে মৌমাছিদের ক্রমাগত পাখা ঝাপটানোর ফলে সঞ্চিত মধু থেকে জলীয় অংশ অনেকটাই বাষ্পীভূত হয়ে যায়। এই কারণে খাঁটি মধুতে জলীয় অংশ সাধারণত ১৭-১৮ শতাংশের বেশি হয় না।
পুষ্টিগুণে খাঁটি মধুর সাথে পাল্লা দিতে পারে এমন খাদ্য পৃথিবীতে খুব কমই আছে। গড় হিসেবে মধুতে থাকে প্রায় ৩৮ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ৩১ শতাংশ গ্লুকোজ, ৭ শতাংশ মল্টোজ, সামান্য পরিমানে সুক্রোজ, ট্রাইস্যাকারাইড ও অন্যান্য শ্বেতসার। এছাড়াও মধুতে থাকে
- ভিটামিন এ, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই ও ভিটামিন কে,
- ক্যালসিয়াম, আয়রণ, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, পটাসিয়াম ও ফসফরাস যুক্ত নানান খনিজ লবণ,
- প্রচুর পরিমানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট,
- বেশ কিছু উৎসেচক বা এনজাইম, এবং
- একগুচ্ছ জীবাণুনাশক (অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল) উপাদান।
তবে মধুতে কোনোরকম চর্বি বা প্রোটিন থাকে না। এক টেবিল চামচ (২১ গ্রাম) খাঁটি মধু প্রায় ৬৪ ক্যালোরি শক্তি যোগান দিতে পারে।
খাঁটি মধুর অসামান্য উপকারিতা
মধু, যদি তা হয় সব রকম ভেজাল ও প্রিজারভেটিভ-হীন সত্যিকারের খাঁটি মধু, তবে তার উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। সবার আগে একটা কথা বলতে হয়। খাঁটি মধু নিয়মিত খেলে ইমিউনিটি, অর্থাৎ, শরীরের নিজস্ব রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। মধু খেলে হজম শক্তি বাড়ে ও শারীরিক দুর্বলতা দূর হয়। দৈহিক ব্যায়ামের সাথে নিয়মিত মধু সেবন বাড়তি মেদ ঝরাতেও সাহায্য করে।
নিয়মিত খাঁটি মধু সেবনে হৃদপেশি ও রক্তনালীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে, এর ফলে হৃদরোগের সম্ভবনা কমে। মধুতে প্রচুর পরিমানে আয়রন বা লোহা থাকায় এটা লোহিত রক্ত কণিকা সহ রক্তের উপাদানগুলো গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মধু রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় হাড় ও দাঁতের গঠনেও মধুর বিশেষ উপকারিতা রয়েছে।
আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত মধু সেবন শ্বাসতন্ত্রকে সুস্থ-সবল রাখতে সাহায্য করে ও হাঁপানি সহ শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হয়। ক্ষত স্থান সারাতেও মধুর উপকারিতা আছে। পোড়া ঘা ড্রেসিং করতে খাঁটি মধু ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও মধুর উপকারিতা যে সব বিষয়ে বিশেষ ভাবে দেখা যায়, সেগুলো হলো
- মধু অনিদ্রার প্রতিকারে সাহায্য করে।
- মধু কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- যারা গ্যাসট্রিক আলসারের সমস্যায় ভুগছেন তাদের পক্ষে মধু বিশেষ উপকারী।
- অনেক সময় ভিটামিনের অভাবে মুখের ভেতরে বা মাড়িতে ঘা হয়। নিয়মিত মধু খেলে এই সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
- দৃষ্টি শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে মধু।
- তাছাড়া ত্বক ও চুলের যত্নে এবং রূপচর্চাতেও মধু অত্যন্ত উপকারী উপাদান হিসাবে গণ্য হয়।
মৌপালন একটি পরিবেশ-বান্ধব উদ্যোগ |
বাজারে মধুর সরবরাহ নির্ভর করে পরিবেশ ও প্রকৃতির সুস্থতার ওপর। দায়িত্ববান মৌপালকরা তাই চেষ্টা করেন মানুষকে সচেতন করে দূষণ মুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার। হুগলী জেলার তরুণ মৌপালক ধৃতিমান ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশকের অতিব্যবহার মৌমাছিদের বিপদ ঘটাতে পারে। এর প্রভাবে মৌমাছিদের ‘কলোনি কোলাপ্স ডিজিজ’ নামে রোগ হবে, যার ফলে শ্রমিক মৌমাছিরা ফুলের রস সংগ্রহের পর বাসা চিনে ফিরে আসতে পারবে না। এছাড়া উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মোবাইল টাওয়ারের নৈকট্যও মৌমাছিদের বিপদে ফেলতে পারে বলে ইদানিং কিছু গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। |
ধৃতিমান বলেন, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতাই তাকে মৌপালনে উদ্যোগী করেছে। কারণ মৌমাছি না থাকলে উদ্ভিদের পরাগসংযোগ ব্যাহত হবে, বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয় নামবে। রোগব্যাধিতে ভারাক্রান্ত আজকের এই দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে ধৃতিমানের মতো তরুণ মৌপালকরা সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে খাঁটি মধু পৌঁছে দেওয়াকে নিছক লাভ কামানোর ব্যবসা হিসেবে দেখছেন না। দেখছেন এক সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে। এটাই আনন্দের কথা, এটাই আশার কথা। |
মধু নিয়ে কিছু পরামর্শ
● মধুতে রয়েছে বেশ কিছুটা জৈব-অ্যাসিড। তাই মধু কখনোই ধাতব পাত্রে রাখা ঠিক নয়।
● বায়ু নিরোধক কাচের পাত্র মধু সংরক্ষণের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী।
● মধুকে কখনোই অতিরিক্ত তাপ দিতে যাবেন না। এতে মধুর অনেক অসামান্য খাদ্যগুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
● মধু ভালো রাখার জন্য ফ্রিজে ঢোকানোর দরকার নেই। ঘরের সাধারণ তাপমাত্রাতে মধু এমনিতেই ভালো থাকে।
● দীর্ঘ সময় ধরে মধু প্রত্যক্ষ সূর্যালোকে না রাখাই ভালো।
শেষের কথা
খাঁটি মধু নিয়ে সমাজে অনেক ভুল ধারণা চালু আছে। যেমন মধু খাঁটি হলে তা কখনোই জমে যাবে না বা তাতে পিঁপড়ে লাগবে না। বা খাঁটি মধু সবসময়ই অত্যন্ত ঘন হয়। আসলে মধুর ঘনত্ব, রঙ, গন্ধ ও স্বাদ, এসবই মধুর উৎস ফুল ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। যেমন, কাশ্মীরের আকাসিয়া মধু খুবই ঘন, আবার সুন্দরবনের মধুতে জলীয় অংশ কিছুটা বেশি। এমন অনেক মধু আছে যেগুলো কড়া শীতেও জমে যায় না, আবার সর্ষে ফুলের মধু শীতকালে জমে যায়। খাঁটি মধু সংগ্রহের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নির্ভরযোগ্য মৌপালকের কাছ থেকে সরাসরি মধু কেনা।
খাঁটি মধুর মতো সুখাদ্য পৃথিবীতে খুব কমই আছে। এই মধু নিয়মিত সেবন করুন। খাঁটি মধু নিয়মিত সেবনই হয়ে উঠতে পারে আপনার পরিবারের স্বাস্থ্যরক্ষার সবচেয়ে বড়ো চাবিকাঠি। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

