ফলফুলের বাগানে বা চাষের জমিতে কীটনাশক বিষের ব্যবহার বর্তমানে মাত্রাছাড়া পর্যায়ে চলে গেছে। পাশাপাশি ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, ঘাসনাশক ইত্যাদি হরেকরকম কৃষিবিষের প্রয়োগও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দুঃখের বিষয়, পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের ওপর এইসব বিষের নানান কুপ্রভাব সত্ত্বেও বৃহত্তর সমাজ এখনো এ বিষয়ে কিছুটা উদাসীন। কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সজাগ না হলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে এর জন্য বিরাট মূল্য চোকাতে হবে।
কীটনাশকের বিপদ
মাটির দূষণ
ডাঙায় বাস্তুতন্ত্রের মূলাধার হলো মাটি। এই অমূল্য মাটিই আজ বিষাক্ত কীটনাশকের প্রভাবে দূষিত। জমিতে বা বাগানে মানুষ যেসব কৃষিবিষ ছড়ায় তার একটা বড়ো অংশ মাটিতে এসে জমে। সাধারণত এই বিষগুলো কৃত্তিমভাবে তৈরি জটিল জৈব যৌগ। বহুক্ষেত্রেই এগুলো সহজে নষ্ট হয় না। এ জাতীয় বিষকে বলা হয় দীর্ঘস্থায়ি জৈব দূষক (Persistent Organic Pollutant)। পরিবেশের ওপর এধরনের কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক। এগুলো মাটিতে বসবাসকারী নানান অণুজীব, কেঁচো ও অন্যান্য উপকারি প্রাণীর সংখ্যা ভীষণভাবে কমিয়ে দেয়। এর ফলে শেষ পর্যন্ত মাটির উর্বরতাই নষ্ট হয়ে যায়।
ক্ষতিকর পোকামাকড় তাড়াতে নানান উদ্ভিজ্জ দ্রব্যের ব্যবহার প্রায় সব দেশেই সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত। পোকা দমনে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার শুরু হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ। ১৮৬০-এর দশকে আমেরিকার মিসিসিপিতে আলুচাষ ‘কলোরাডো আলু-বিটল’ পোকা থেকে মুক্ত করতে প্রথম প্যারিস গ্রিন নামক একটি আর্সেনিকঘটিত বিষাক্ত যৌগ ব্যবহৃত হয়। এই সময় থেকে আমেরিকা ও ইউরোপে কীটনাশক হিসেবে নানান অজৈব লবণের প্রয়োগ ব্যাপকভাবে শুরু হয়। |
জলের দূষণ
আজকের পৃথিবীতে এমন কোনো জলাশয়, নদী বা হৃদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেটা কীটনাশকের বিষময় প্রভাব থেকে মুক্ত। বস্তুত, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষিবিষ জনিত জল দূষণ বর্তমানে পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের পক্ষে এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিক্ষেত্রের বিষ নানাভাবে জলকে দূষিত করতে পারে। যেমন:
➤জমিতে কীটনাশক বিষ দেওয়ার পর তা বৃষ্টির জলে বা সেচের জলে ধুয়ে আশেপাশের জলাশয়, খালবিল, নদ-নদীতে এসে মিশে যেতে পারে।
➤জলে দ্রবীভূত হয়ে বিষাক্ত কীটনাশক লিচিং-এর মাধ্যমে পৌঁছে যেতে পারে ভূগর্ভের জলস্তরে, যা এ যুগে মানুষের পানীয় জলের অন্যতম প্রধান উৎস।
➤কীটনাশকে বিষিয়ে যাওয়া মাটি ভূমিক্ষয়ের ফলে জলে এসে পড়লে তা থেকে জলে বিষ মিশে যেতে পারে।
➤বিষাক্ত কীটনাশকের বাষ্প বায়ু চালিত হয়ে জলের সংস্পর্শে এলে, জলে দ্রবীভূত হয়ে যেতে পারে।
➤এছাড়াও সরাসরি জলে কীটনাশক বিষ দেওয়া বা দুর্ঘটনার ফলে জলে এধরনের বিষ মিশে যাওয়ার ঘটনাও কম ঘটেনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪০ সালে DDT আবিষ্কৃত হলে দেখা যায় কৃত্রিমভাবে তৈরি জটিল রাসায়নিক যৌগ কীটনাশক হিসেবে উদ্ভিদজাত পদার্থ ও অজৈব লবণগুলোর থেকে অনেক শক্তিশালী। মশা ও মাছি সহ নানান কীটপতঙ্গ নিধনে DDT-র কার্যকারিতা শত শত রাসায়নিক কীটনাশকের বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বহুল ব্যবহারের পথ করে দেয়। সেই ধারা আজও চলছে। |
বায়ুর দূষণ
চাষের জমি থেকে বিষাক্ত কীটনাশকের বাষ্প ও তরলকণা সহজেই বায়ু বাহিত হয়ে দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ থেকে বন্যপ্রাণের ক্ষতি হয়। মানুষের নিজেদের বসবাসের এলাকাও বায়ু বাহিত কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে না। কিছু কিছু কৃষিবিষের বাষ্প বায়ুতে দীর্ঘকাল অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়। অন্যগুলো নানান উদ্বায়ী জৈব যৌগে (Volatile Organic Compound) পরিণত হয়। এধরনের উদ্বায়ী যৌগ প্রায়শই মারাত্মক বায়ু দূষণ ঘটায়। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো ঊর্ধ্বাকাশের ওজোন স্তরেরও ক্ষতি করে।
কীটনাশকের ভয়ঙ্কর পরিণতি: বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয়
সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে কৃষিবিষগুলো মস্তো বড়ো অভিশাপ। কীটনাশক প্রয়োগে শুধু যে ক্ষতিকর পোকামাকড়ই মরে তা একেবারেই নয়। মৌমাছি, প্রজাপতির মতো বন্ধুপোকারাও এতে মারা পড়ে। মানুষের চাষবাসে এই বন্ধুপোকাদের অবদান কম নয়। পৃথিবীতে ৭৫ শতাংশ ফসল ফলার পেছনে রয়েছে বন্ধুপোকাদের ঘটানো পরাগমিলন। কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় এদের সংখ্যা আজ উদ্বেগজনকভাবে কমে যাচ্ছে। তাছাড়া জলের মাছ থেকে শুরু করে ডাঙার ব্যাঙ, পাখি, মাটির নানা অণুজীব, কেঁচো, আরো অসংখ্য প্রাণী কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবে ক্রমশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এমনকি যে গাছেদের বাঁচাতে কৃষিবিষ প্রয়োগ করা হয়, তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষেও এগুলো দারুণ ক্ষতিকর।
১৯৬২ সালে মার্কিন জীববিজ্ঞানী রেচেল কারসন ‘নীরব বসন্ত’ (‘Silent Spring’) বইটি প্রকাশ করে DDT ও অন্যান্য রাসায়নিক কীটনাশকের ক্ষতিকর দিকগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরেন। সারা বিশ্বের বিষ-বিরোধী জনমতের ক্ষেত্রে এই বইটিকে এক মাইলফলক রূপে গণ্য করা হয়। বইটিতে লেখিকা দেখিয়েছেন, কীভাবে রাসায়নিক কৃষিবিষগুলোর বিষক্রিয়ায় পাখিদের মৃত্যু ঘটছে ও পাখিদের কলতান না থাকায় বসন্ত ঋতু উচ্ছ্বাসহীন হয়ে পড়ছে। বিষাক্ত কীটনাশকের প্রভাবে মানুষের মধ্যে ক্যানসার ও অন্যান্য রোগ যে ব্যাপকহারে বেড়ে যাচ্ছে, এই সত্যটাও তিনি তুলে ধরেন। |
কীটনাশকের বিষময় ফল মানব স্বাস্থ্যের অপরিমেয় ক্ষতি
মানব স্বাস্থ্যের ওপর নানান কৃষিবিষের মারাত্মক কুপ্রভাব আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এ যুগে আমরা যে সব ফলমূল, শস্য ও তরিতরকারি বাজার থেকে কিনে খাই, তার মধ্যে প্রায়শই থাকে কীটনাশক বিষের অবশেষ। অনেক এলাকায় পানীয় জলে মিশে থাকে বিষাক্ত কীটনাশক। প্রাণীজ খাদ্যের মধ্যে জমে থাকা বিষও মানুষের শরীরে চলে আসে। তাছাড়া প্রয়োগের এলাকা থেকে বায়ু বাহিত হয়ে শ্বাসের মাধ্যমেও মানুষের দেহে শোষিত হয় বিষাক্ত কীটনাশকের বাষ্প।
দীর্ঘদিন এভাবে চলার ফলে মানুষের দেখা দেয় নানা দুরারোগ্য ব্যাধি। কমে যায় নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ শক্তি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় সারা বিশ্বে মানুষের যেসব রোগ ও বিকৃতি বর্তমানে খুব বেশি বেড়ে গেছে সেগুলো হলো,—
- ত্বকের প্রদাহ,
- নানা চর্মরোগ,
- টিউমার,
- কিডনির বৈকল্য,
- লিভারের নানা রোগ,
- নানা ধরনের ক্যানসার,
- লিউকিমিয়া,
- মহিলাদের স্তন ক্যানসার,
- নানান স্নায়ুরোগ,
- অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ,
- হরমোনের ভারসাম্য ব্যাহত হওয়া,
- জিনগত বিকৃতি,
- জন্মগত বিকলাঙ্গতা, ইত্যাদি।
কীটনাশকের কুফল রুখতে চাই জন জাগরণ
সারা বিশ্বের পরিবেশ সচেতন মানুষেরা আজ আন্তরিকভাবে চাইছেন, সর্বক্ষেত্রে কীটনাশক বিষের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হোক। বিশেষ করে অর্গানোফসফেট ও অন্যান্য অতিবিষাক্ত কীটনাশকের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়া দরকার।
বর্তমানে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষিবিষ ব্যবহারকারী দেশ হলো চিন। ২০১৯ সালে এই দেশ মোট ১৭,৬৩,০০০ মেট্রিক টন কৃষিবিষ ব্যবহার করেছিলো। কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষিবিষ ব্যবহারে দ্বিতীয় স্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সালে আমেরিকার ব্যবহৃত কৃষিবিষের মোট পরিমান ছিলো ৪,০৭,৭৭৯ টন। তৃতীয় স্থানে থাকা ব্রাজিল ঐ বছর ব্যবহার করেছিলো মোট ৩,৭৭,১৭৬ টন বিষ। ২০১৯ সালে ভারতে ব্যবহৃত কৃষিবিষের মোট পরিমান ছিলো ৫২,৭৫০ মেট্রিক টন। [worldometer] |
কৃষিক্ষেত্রের ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের বিকল্প পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করলে খুব সহজেই কীটনাশক বিষের বিপদ এড়ানো সম্ভব। প্রথম কথা, ফল, ফুল, শস্যের দেশজ জাত চাষ করলে কীটনাশকের প্রয়োজন কম পড়ে, কারণ এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই বেশি। তাছাড়া, প্রাকৃতিক উপায়ে মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারলেও গাছে রোগপোকার উপদ্রব কম হয়। ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফেলে এমন প্রাণী, যেমন, ব্যাঙ, পাখি, এদের সংরক্ষণ করা পোকাদমনের আরেকটা কার্যকর উপায়। এগুলো ছাড়াও অপকারী পোকাদের সংখ্যা কমানোর আরো অনেক নিরাপদ পদ্ধতি আছে, যেমন, ১)আলোক ফাঁদ, রঙীন ফাঁদ বা ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার, ২)পর্যবেক্ষণের সাহায্য বিনাশ, ৩)বংশবৃদ্ধির জায়গা নষ্ট করে দেওয়া, ইত্যাদি।
সব শেষে যেটা বলার, কীটনাশকের বিপদ থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে, সরব হতে হবে। জনসাধারণের সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া বিষমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]