খাদ্য হলো বেঁচে থাকার এক মৌলিক উপকরণ। এখানে বেঁচে থাকা মানে যেমন তেমন ভাবে বেঁচে থাকা নয়, বরং সুস্থ ও কর্মঠ ভাবে বেঁচে থাকা। জীবনে খাদ্যের এই অসামান্য গুরুত্বের কারণে দৈনন্দিন আহার্য বস্তুগুলো সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট সাবধানী থাকা দরকার। গত কয়েক দশকে যেভাবে একের পর এক সংক্রামক রোগের মহামারি দেখা দিচ্ছে এবং যেভাবে নানা অসংক্রামক রোগেরও বাড়বাড়ন্ত ঘটছে তাতে বাজারে প্রচলিত খাদ্যবস্তুগুলো নিয়ে আমাদের প্রশ্ন তুলতেই হচ্ছে। আসুন, আজ আমরা এমনই কিছু প্রশ্ন তুলি আর সেগুলোর উত্তরও খোঁজার চেষ্টা করি।
আচ্ছা, আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, বাজার থেকে কিনে এনে যেসব খাবার সপরিবারে খান— শাকসব্জি, মাছমাংস, দুধ, ডিম থেকে শুরু করে হরেক কিসিমের জাঙ্ক ফুড— স্বাস্থ্যের পক্ষে এগুলো কতোটা নিরাপদ? সত্যি কথা যদি বলতে হয়, গুণমানের দিক থেকে আধুনিক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি সফল বলা যায় না। মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনের জন্য আজকাল যে ফ্যাক্টরি ফার্মিং পদ্ধতি অতি প্রচলিত তা নিয়েই আজ কিছুটা আলোচনা করা যাক।
অ্যানিম্যাল ফার্ম, নাকি ভাইরাসের আঁতুরঘর?
নিবিড় পদ্ধতিতে প্রাণীজ খাদ্য উৎপাদনের নাম ফ্যাক্টরি ফার্মিং। এর মূল কথা কম জায়গার মধ্যে বেশি সংখ্যায় প্রাণী পালন। এই পদ্ধতি নাকি বিজ্ঞান সম্মত। বলা হয়, এতে প্রাণীজ খাদ্যের উৎপাদন অনেক বেশি হয়। কিন্তু সত্যিটা কী? পোলট্রি ফার্ম, অর্থাৎ, মুরগির খামারের ব্যাপার স্যাপারই একটু খতিয়ে দেখা যাক। বর্তমানে মুরগিই মানুষের আমিষ জাতীয় খাদ্যের সবচেয়ে বড়ো উৎস। তবে মুরগির খামারে যা ঘটে তা অন্যান্য প্রাণী, যেমন গরু, ছাগল, শূকর, ভেড়া ইত্যাদির আধুনিক খামারগুলোতে অনেকটা একই ভাবে ঘটে থাকে, এটা বুঝে নিতে হবে।
আধুনিক পোলট্রি ফার্মগুলোতে বেশি মুনাফার লোভে থাক-বিশিষ্ট সংকীর্ণ খাঁচায় খুব কম জায়গার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে মুরগিদের আটকে রাখা হয়। এই মুরগিরা না পায় সূর্যের আলো না পায় খোলা বাতাস। খাঁচার ভেতর পাখিদের মলমূত্র ঠিকঠাক সাফাই করার কোনো ব্যবস্থাও থাকে না। এখানে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অর্থ অস্বাভাবিক দ্রুততায় বেড়ে মাংস হয়ে যাওয়া অথবা ক্রমাগত ডিম পেড়ে অল্প দিনের মধ্যেই মৃত্যু বরণ করা।
ফার্মের অস্বাস্থ্যকর, ভীড়ে-ঠাসা পরিবেশ মুরগিদের মধ্যে বার্ড ফ্লু সহ মারাত্মক সব পাখি ভাইরাস (H5, H7, ইত্যাদি) ছড়িয়ে পড়ার পক্ষে আদর্শ। গত কয়েক দশকে কীভাবে একের পর এক বার্ড ফ্লু মহামারি বিভিন্ন দেশে খামারের পাখিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তা মনে করুন। তাহলেই এর সত্যতা বুঝতে পারবেন। কিছু কিছু পাখি ভাইরাস আবার মুরগি থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তেও সক্ষম। এই সব ভাইরাস থেকে মানুষের ক্ষতির আশংকা কম নয়। এরকম আরেকটা রোগ হলো সোয়াইন ফ্লু। এটা মূলত শূকরদের রোগ হলেও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ২০০৯-১০ সালে সোয়াইন ফ্লু (H1N1)-এর মহামারিতে সারা পৃথিবীতে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো। |
ফার্মে বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়ার চাষ!
খামারগুলোর নারকীয় পরিবেশে থাকা প্রাণীদের শুধু যে ভাইরাল রোগের ভয় আছে তা নয়, ভয় আছে নানান ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগেরও। বিশেষ করে সালমোনেলা, ইকোলাই, ক্যামপাইলোব্যাকটার, ইত্যাদি নানা জাতের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ এই খামারগুলোতে খুবই বেশি। সমস্যার সমাধান হিসেবে এসব খামারে একটা অদ্ভুত কাজ করা হয়। প্রাণীদেরকে— এমনকি সুস্থ অবস্থাতেও— নিয়মিত ভাবে খাবার ও জলের সাথে নানা রকম অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ অল্প মাত্রায় নিয়মিত খাওয়ানো হয়। এসব অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের বেশ কয়েকটি আবার মানুষের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়।
নিয়মিত ভাবে খামারের পশুপাখিদের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর ফলে এদের শরীরে ঢুকে পড়া কিছু ব্যাকটেরিয়া গোড়াতেই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সব ব্যাকটেরিয়া এভাবে মরে না। যে ব্যাকটেরিয়াগুলো ওষুধের ধাক্কা সামলে টিকে যায় সেগুলো এরপর আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেগুলোকে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধে আর দমানো যায় না। এ ধরণের ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। খামারি পশুপাখি বা তাদের মাংসের পরিবহণ, বেচাকেনা ও ব্যবহারের সময় এই সব মারাত্মক ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার প্রবল সম্ভবনা থাকে। |
আজ সারা পৃথিবীতেই মানুষের মধ্যে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। বেড়ে চলেছে এ থেকে ঘটা মৃত্যুর সংখ্যা। এর পেছনে ফ্যাক্টরি ফার্মিং এর বড়ো ভূমিকা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ বছর আগে থেকেই ফার্মগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের নির্বিচার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য বলে আসছে। এখন এটা উদ্বেগজনক জায়গায় চলে যাওয়ার পর অনেক দেশের সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু এগুলোতে যে খুব একটা কাজ হচ্ছে তা বোধহয় বলা যাবে না।
ডেয়ারি ফার্মে গোদুগ্ধ নিষ্কাশন
গ্রোথ হরমোনের অপার মহিমা!
মাংস, দুধ বা ডিম চটজলদি বেশি পরিমানে উৎপাদন করার লোভে আজকাল বহু খামারেই পালিত প্রাণীদের নানা রকম গ্রোথ হরমোন ইনজেক্ট করা হয়। এই হরমোনগুলোর অবশেষ মাংস ও অন্যান্য প্রাণীজ খাদ্যে থেকে যায়। এ ধরনের খাদ্য নিয়মিত খাওয়ার ফলে মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যানসার, পুরুষদের প্রস্টেট ক্যানসার ও মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে কোলোন ক্যানসারের সম্ভবনা বেড়ে যায়। আজকাল এ ধরনের ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পেছনে ফ্যাক্টরি ফার্মিং জাত খাদ্যের ভূমিকা আছে, এমন বক্তব্য মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
মানব স্বাস্থ্যের ওপর নিম্নমানের খাদ্যের কুপ্রভাব
প্রাণীদেরকে জঘন্য পরিবেশে রেখে, অস্বাভাবিক খাদ্য খাইয়ে, নানা রকম ওষুধ, বিষ ও হরমোন প্রয়োগ করে ফ্যাক্টরি ফার্মগুলোতে যে সব খাদ্য উৎপন্ন হচ্ছে, তার গুণমান কেমন হতে পারে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। অনেকেই বলছেন, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, কিডনি ও লিভারের অসুখ, হাইপারটেনশান, ইত্যাদি নানা অসংক্রামক রোগের প্রকোপ আজকাল খুব বেশি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো ফ্যাক্টরি ফার্ম জাত প্রাণিজ খাদ্য নিয়মিত খাওয়া। যারা এইসব রোগে ভুগছেন তাদের আবার সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের শক্তিও বেশ কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কভিডের মতো মারণব্যাধি জাল ছড়ালে এ ধরনের মানুষেরাই কিন্তু সবচেয়ে বেশি বিপদের মধ্যে পড়েন।
বিতর্ক চলুক, বিকল্প আসুক
ফ্যাক্টরি ফার্মগুলোতে যেভাবে অসহনীয় পরিবেশে আটকে রেখে পালিত প্রাণীদের জীবনভর যন্ত্রণা দেওয়া হয় সেটা নিঃসন্দেহে অমানবিক। অন্যদিকে এই ফার্মগুলোতে উৎপন্ন মাংস ও অন্যান্য প্রাণীজ খাদ্য মানুষের জন্যও পুরোপুরি নিরাপদ নয়।
ফার্মগুলোতে বেশি উৎপাদনের যে গল্পটা শোনানো হয়, তার মধ্যে অনেকটাই অতিরঞ্জন। আপাত দৃষ্টিতে আপনি দেখছেন, ফ্যাক্টরি ফার্মে কম জায়গায় অনেক বেশি প্রাণীকে পালন করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের খাবারের জোগান দিতে গিয়ে যে প্রচুর কৃষিজমি ব্যবহার করতে হচ্ছে সেটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। ফ্যাক্টরি ফার্মিং-এ আসলে যে পরিমাণে শক্তি, জমি ও সম্পদ ব্যায় করতে হয়, তাতে একে খুব বেশি উৎপাদনশীল মোটেও বলা যায় না।
তবে ব্যাপারটা শুধু ফ্যাক্টরি ফার্মিং নয়, সামগ্রিক ভাবেই দৈনন্দিন খাদ্যের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তাকে আজ আমাদের খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। নইলে আগামী দিনে অনেক বড়ো ক্ষতির মধ্যে পড়তে হবে আমাদেরকেই। তাই এ বিষয়ে আলোচনা বাড়ুক, বিতর্ক চলুক। পৃথিবীর সব মানুষ যাতে যথেষ্ট পরিমানে ভালো খাবার খেতে পায় ও সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তার জন্য রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে আলোকপ্রাপ্ত সমাজকেই। [কৃতজ্ঞতা: The Guardian] [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

