মশা নাকি মশার কয়েল, কোনটি বেশি ক্ষতিকর?

মশার কয়েলের ক্ষতিকর দিক আছে কি না, ব্যবহারের আগে জেনে নেওয়া উচিত।

আমাদের দেশে গরম পড়ার সাথে সাথে মশার প্রকোপ বেড়ে যায়। আর বর্ষা নামতে নামতে মশা রীতিমতো আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মশার জ্বালায় কাজকর্মের ক্ষতি তো হয়ই, সাথে থাকে মশার কামড় থেকে নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়। সমস্যা সমাধানের চটজলদি উপায় হিসেবে অনেকে কয়েল জ্বালান। অনেকে তো কয়েল জ্বালিয়ে ঘরের দরজা জানালা পর্যন্ত বন্ধ করে দেন। এমন কাজ নিরাপদ কি না সেটা হয়তো তারা ভেবে দেখেন না। আসলে কিন্তু মশার চেয়ে মশার কয়েলের ধোঁয়া মোটেই কম ক্ষতিকর নয়।

মশার কয়েল: লাভ ক্ষতির হিসেব

মশা তাড়াতে কয়েলের ধোঁয়া কিছুটা কাজ যে করে না তা নয়। বিশেষ করে বদ্ধ জায়গায় এগুলো বেশি কাজ করে। বর্তমানে শুধু আমাদের দেশে নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা পৃথিবীতেই মশার প্রকোপ বাড়ছে। সাথে বাড়ছে মশাবাহিত ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, চিকানগনিয়া, ফাইলেরিয়া বা পীতজ্বরের মতো নানান রোগের তান্ডব। এই অবস্থায় সপরিবারে সুস্থভাবে বাঁচার প্রয়োজনে কয়েল ব্যবহার করলে ক্ষতি কি?

ক্ষতি আছে। আর সেই ক্ষতির দিকগুলো হিসেবে ধরলে মশার কয়েল নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবা ছাড়া উপায় থাকেনা। এ ধরনের কয়েলের ধোঁয়ায় থাকে নানা বিষাক্ত যৌগের বাষ্প। থাকে প্রচুর পরিমানে ভাসমান সূক্ষ্ম কণা। এই ধোঁয়া শুধু মশাই তাড়ায় না, মানুষেরও ক্ষতি করে। আসলে হয়তো মশার চেয়ে মানুষেরই ক্ষতি বেশি হয়। কারণ কয়েল জ্বাললে মশারা সেখান থেকে সরে যায়। কিন্তু মানুষ কয়েল জ্বেলে নিজে সেই কয়েলের বিষাক্ত ধোঁয়ার মধ্যেই বসে থাকে।

অতীতে প্রায় সব দেশেই মানুষ মশার হাত থেকে বাঁচতে নানারকম প্রাকৃতিক পদার্থের ধোঁয়া ব্যবহার করতো। তবে আধুনিক মশা তাড়ানোর ধূপ প্রথম তৈরি হয় জাপানে, ১৯ শতকের শেষদিকে। তৈরি করেছিলেন এইচিরো উএয়ামা নামের এক ব্যবসায়ি। কমলালেবুর খোসার গুঁড়ো, শ্বেতসার গুঁড়ো ও পাইরেথ্রাম নামের এক প্রাকৃতিক পদার্থ মিশিয়ে তিনি লম্বাটে গড়নের সেই ধূপ তৈরি করেছিলেন। পরে স্ত্রী ইউকি তাকে পরামর্শ দেন ধূপটা প্যাঁচালো আকারে তৈরি করার, যাতে সেটা বেশিক্ষণ জ্বলে। এভাবেই জন্ম নেয় আধুনিক মশার কয়েল। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর এ ধরণের কয়েলের ব্যবহার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

মশার কয়েলে কী থাকে জেনে রাখুন

ঠিক কী ধরনের উপাদান দিয়ে মশার কয়েল তৈরি হয় জানলে হয়তো অনেকেই আর কয়েল জ্বালতে চাইতেন না। আজকাল বাজারে যেসব মশার কয়েল পাওয়া যায় সেগুলোতে থাকে নানারকম বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। পাইরেথ্রিন (pyrethrin) জাতীয় কীটনাশক তো থাকেই, তা ছাড়াও কয়েলে থাকতে পারে আরো নানা ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক বিষ, যেমন—

  • অ্যালেথ্রিন,
  • এসবায়োথ্রিন,
  • মিপারফ্লুথ্রিন,
  • বিউটাইলেটেড হাইড্রক্সিটলুইন,
  • পাইপেরোনাইল বিউটক্সাইড,
  • এন-অক্টাইল বাইসাইক্লোহেপটিন ডাইকারবক্সিমাইড,
  • অক্টাক্লোরোডাইপ্রোপাইলইথার, ইত্যাদি।

এই বিষাক্ত যৌগগুলো ছাড়াও বাইন্ডার হিসেবে এবং জ্বালানি হিসেবে বেশ কিছু পদার্থ মশার কয়েলে যোগ করা হয়।

মশার কয়েলের ক্ষতিকর দিক

ধোঁয়ায় বিষের বাষ্প

মশার কয়েল জ্বাললে তৈরি হয় নানান বিষাক্ত উদ্বায়ী যৌগ, যেমন, ফরম্যালডিহাইড, বেনজিন, বেনজোপাইরিন, ফেনল, অর্থোক্রেসল, ইত্যাদি। এগুলোর কয়েকটা সম্ভাব্য কার্সিনোজেন (carcinogen) বা ক্যানসার সৃষ্টিকারি পদার্থ হিসেবে পরিচিত। একটা মশার কয়েল জ্বাললে এই সব বিষাক্ত যৌগের বাষ্প যে পরিমানে তৈরি হয়, তা প্রায় ৫০টা সিগারেট জ্বালানোর সমান। শ্বাসনালি ও ফুসফুসের পক্ষে তাই কয়েলের ধোঁয়া দারুণ ক্ষতিকর। শিশু বয়স থেকে এই বিষ-ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে থাকলে ক্রনিক অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিস জাতীয় শ্বাসতন্ত্রের রোগ হওয়া অনিবার্য। দিনের পর দিন এই ধোঁয়ায় শ্বাস নিলে ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়। এছাড়াও মশার কয়েলের ধোঁয়া থেকে অ্যালার্জি, নানা চর্মরোগ ও চোখের কর্নিয়ার রোগ হওয়ারও প্রবল সম্ভাবনা থাকে।

সূক্ষ্ম কণার বিপদ

বিষাক্ত জৈব বাষ্প ছাড়াও মশার কয়েল জ্বাললে তৈরি হয় বাতাসে ভাসমান অসংখ্য সূক্ষ্ম কণা। নানান ভারি ধাতুর কণাও এর মধ্যে মিশে থাকে। এ দিক থেকে একটা মশার কয়েল প্রায় ১০০টা সিগারেটের সমতুল্য। এই কণাগুলো শ্বাসের সাথে ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম কণাগুলো রক্তেও মিশে যেতে পারে। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এই কণাগুলোর প্রভাব মারাত্মক। এগুলো ফুসফুস, হার্ট, মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের দারুণ ক্ষতি করে। দীর্ঘমেয়াদি ফল হিসেবে ক্যানসারের সম্ভবনাও বেড়ে যায়।

মশার কয়েলের ধোঁয়া দারুণ ক্ষতিকর

মশার কয়েলের ধোঁয়া কম ক্ষতিকর নয়

মশা তাড়ানোর বিষবিহীন উপায় খুঁজতে হবে আমাদের

মশার কয়েল মানুষ বা পোষ্য প্রাণীদের স্বাস্থ্যের পক্ষে যে কতটা ক্ষতিকর তা আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন। শুধু কয়েল কেনো, মশা তাড়ানোর ম্যাট, লোশন, ক্রিম, স্প্রে, লিকুইড রেপেলেন্ট, এগুলোর কোনোটাকেই ১০০ শতাংশ নিরাপদ বলে ধরা যায় না। রাসায়নিক নির্ভর এই বস্তুগুলো দৈনন্দিন জীবনে যতোটা সম্ভব কম ব্যবহার করাই ভালো। এগুলোর বদলে মশার হাত থেকে বাঁচার বিকল্প নিরাপদ পদ্ধতি অনুসরণের কথা আমাদের ভাবতে হবে।

এজন্য প্রথমেই বাড়ির ভেতর ও আশপাশ আমাদের পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, কোথাও জল জমে থাকতে দেওয়া যাবে না। এতে মশার বংশবৃদ্ধি কমবে। এর পাশাপাশি মশা তাড়ানোর জন্য বিভিন্ন যান্ত্রিক পদ্ধতি কাজে লাগানো যেতে পারে। এগুলোর মধ্যে পড়ে ঘরের দরজা জানালায় মশারোধি জাল লাগানো, শরীর ঢাকা পোশাক পড়া, পায়ে মোজা পড়া, বিশ্রামের সময় মশারি ব্যবহার করা, ইত্যাদি। মশার কয়েল বা কৃত্তিম রাসায়নিক নির্ভর কোনো দ্রব্য ব্যবহার না করে মশা তাড়ানোর কাজে আমরা সিট্রোনেলা বা নিম জাতীয় প্রাকৃতিক তেল ব্যবহার করতে পারি। বিশেষজ্ঞরা আরো জানাচ্ছেন, বাদুড়, চামচিকে, ব্যাঙ ইত্যাদি পতঙ্গভুক প্রাণীকে কাজে লাগিয়েও পরিবেশে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব|| [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]