
মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী হলেও প্রজাতি হিসেবে খুব একটা প্রাচীন নয়। পৃথিবীতে টিকে থাকার ক্ষেত্রে মানুষের অনেক পরীক্ষাই বাকি। এদিক থেকে দেখলে বেশ কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদের সাফল্য মানুষের পক্ষে ঈর্ষণীয় হতে পারে। এই প্রজাতিগুলো কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর বুকে সফলভাবে টিকে আছে। এদের মধ্যে নাল কাঁকড়া (Horse Shoe crab) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আশ্চর্য প্রাণী নাল কাঁকড়া
নাল কাঁকড়া আর্থ্রোপডা পর্বের অন্তর্গত অমেরুদন্ডী প্রাণী, সারা পৃথিবীতে এদের ৪টে প্রজাতি আছে। নামে কাঁকড়া হলেও আসলে বিছে জাতীয় প্রাণীদের সাথেই এদের মিল। সমুদ্রের লবণাক্ত জলে এদের বসবাস। বসন্তের শেষ দিকে প্রজনন মরশুমে এরা দলে দলে উপকূলের বালুকাবেলায় উঠে আসে। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের আটলান্টিক উপকূলে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন উপকূলে প্রচুর নাল কাঁকড়া দেখা যায়। এরা খুবই নিরীহ প্রাণী।
নানারকম শামুক ও কৃমি নাল কাঁকড়ার প্রধান খাদ্য। এছাড়া এরা ছোটো ছোটো মাছ ও কাঁকড়াও খেয়ে থাকে। ওপর থেকে দেখতে নাল কাঁকড়ার মাথা অনেকটা সৈনিকদের হেলমেটের মতো। এদের সারা দেহ শক্ত খোলায় ঢাকা। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে থাকে ৫ জোড়া পা ও একটা লেজ। নাল কাঁকড়ার সব মিলিয়ে ৯টা চোখ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রধান দুটো পুঞ্জাক্ষী, এদুটো মাথার সামনের দিকে থাকে ও বেশি ব্যবহৃত হয়। বাকিগুলো দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে থাকে, এগুলো মূলত আলোর উৎস বুঝতে সাহায্য করে।
এক একটা নাল কাঁকড়া স্বাভাবিক পরিবেশে গড়ে প্রায় ২০ বছর বাঁচে। স্ত্রী নাল কাঁকড়া আকারে পুরুষ নাল কাঁকড়ার চেয়ে প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বড়ো। নাল কাঁকড়ার দৈর্ঘ ৮০ সেমি পর্যন্ত তথা ওজন ৪ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর বুকে কোটি কোটি বছর অপরিবর্তিত রূপে টিকে থাকার সুবাদে নাল কাঁকড়াকে জীবন্ত জীবাশ্ম হিসেবে গণ্য করা হয়।
ধরাপৃষ্ঠে প্রজাতির আবির্ভাব ও বিলুপ্তি
বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিটা জীবের যেমন জন্ম ও মৃত্যু আছে তেমনই প্রতিটা প্রজাতির আছে আবির্ভাব ও বিলুপ্তি। বিবর্তনের পথ ধরে পুরোনো প্রজাতির একাংশ থেকে নতুন প্রজাতির উদয় হয়। আবার প্রাকৃতিক ঘটনার অভিঘাতে অনেক প্রজাতির বিলুপ্তিও ঘটে। যে প্রজাতিগুলো প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নিতে দক্ষ তারাই কেবল কোটি কোটি বছর ধরে অপরিবর্তিত রূপে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে পারে। ভূতাত্ত্বিক সময়ের বিচারে এই প্রজাতিগুলোকে সফল বলে ধরা যায়। নাল কাঁকড়া এমনই এক সফল প্রজাতি।
ফসিল রেকর্ড বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীর বুকে প্রথম বহুকোষী প্রাণী প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছিলো প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে। সেই প্রাচীন প্রজাতি থেকে পরবর্তীকালে অসংখ্য প্রাণী বিকাশ লাভ করলেও মূল প্রজাতিটা বহু পূর্বেই লুপ্ত হয়ে গেছে। আরেকটা উদাহরণ ডাইনোসর টিরানোসরাস রেক্স। ফসিলের সাক্ষ্য বলে, পৃথিবীর বুকে এই ডাইনোসররা প্রায় ৩০ লক্ষ বছর রাজত্ব করার পর অবশেষে মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এদের তুলনায় টিকে থাকার ক্ষমতার বিচারে নাল কাঁকড়া অসাধারণ। এই প্রজাতির যে প্রাচীনতম ফসিল পাওয়া গেছে তা প্রায় ৪৫ কোটি বছরের পুরানো। অর্থাৎ, পৃথিবীতে নাল কাঁকড়া অন্তত ৪৫ কোটি বছর ধরে সগৌরবে বিরাজমান। |
নাল কাঁকড়া ও অন্যান্য প্রাচীন প্রজাতি
নাল কাঁকড়া ছাড়াও আরও কয়েকটা অতিপ্রাচীন প্রাণী প্রজাতি আমাদের সমীহ আদায় করে নিতে পারে। যেমন,
- নটিলাস ও
- জেলিফিশ।
নটিলাসের প্রাচীনতম যে ফসিল পাওয়া গেছে তা ৫০ কোটি বছরের পুরানো। জেলিফিশের প্রাচীনতম ফসিলের বয়স আরো বেশি, প্রায় ৫৫ কোটি বছর। তবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই প্রাণীগুলোর প্রাচীনতম রূপের সাথে বর্তমান রূপের খানিকটা তফাত আছে। সেদিক থেকে নাল কাঁকড়া অনন্য। কারণ এর প্রাচীনতম রূপের সাথে বর্তমান রূপের তেমন একটা পার্থক্য নেই। অর্থাৎ, ৪৫ কোটি বছর ধরে নাল কাঁকড়া প্রায় অপরিবর্তিত রূপে পৃথিবীতে টিকে আছে।
প্রাচীন প্রজাতির সাফল্যের রহস্য
নাল কাঁকড়া ও অন্যান্য সুপ্রাচীন প্রজাতিগুলোর এতো দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীতে টিকে থাকার রহস্য কী তা বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। পৃথিবীর প্রাচীনতম উদ্ভিদ প্রজাতি জিংকগো বিলোবা বৃক্ষের প্রাচীনতম যে ফসিল পাওয়া গেছে তার বয়স প্রায় ২৭ কোটি বছর। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই গাছটার কাঠের রয়েছে ক্ষতিকর পোকামাকড় প্রতিরোধ করার আশ্চর্য ক্ষমতা। এই ক্ষমতাই জিংকগোকে কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে টিকে থাকতে সাহায্য করছে। [আরো পড়ুন: জিংকগো বিলোবা: আশ্চর্য এক বৃক্ষ প্রজাতি]
নাল কাঁকড়ার ব্যাপারটাও অনেকটা এরকম। হিমোসায়ানিন নামের কপার-যুক্ত যৌগ থাকায় নাল কাঁকড়ার রক্তের রঙ নীল। এদের রক্তে থাকে অ্যামিবোসাইট নামক এক ধরণের অতি-শক্তিশালী রক্ষী কোষ। এছাড়াও নাল কাঁকড়ার রক্তে এমন কিছু দুর্লভ প্রোটিন রয়েছে যা যে কোনো আক্রমণকারী জীবাণুকে নিমেষের মধ্যে ঘিরে ফেলে নিকেশ করে দিতে পারে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, নাল কাঁকড়ার রক্তের কার্যকর রোগপ্রতিরোধ শক্তি প্রজাতি হিসেবে এর সাফল্যের অন্যতম মুখ্য কারণ। নাল কাঁকড়ার রক্তের এই অসাধারণ গুণের জন্য মানুষ প্রতি বছর এই প্রাণীটিকে হাজার হাজার সংখ্যায় ধরে তাদের রক্ত বের করে নেয় এবং তা থেকে জীবাণু চিহ্নিতকরণের কাজে ব্যবহৃত লিমুলাস অ্যামিবোসাইট লাইসেট নামক পদার্থ তৈরি করে। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে সফলভাবে টিকে থাকার পর বর্তমানে মানুষের এহেন আগ্রাসী কাজে নাল কাঁকড়ার মতো চমৎকার প্রাণী বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]