খাবার ও জল রাখার কাজে নানারকম প্লাস্টিকের পাত্র আজকাল আমরা হরদম ব্যবহার করি। এধরনের পাত্র ব্যবহারের আগে প্রথমেই একটা বিষয় দেখে নেওয়া ভালো। ঐ পাত্রটা যে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি তা স্বাস্থ্যের পক্ষে যথেষ্ট নিরাপদ তো? অনিরাপদ প্লাস্টিকের বোতল বা অন্য কোনো আধার খাদ্য-পানীয় রাখার কাজে দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে নানান রোগব্যাধি দেখা দিতে পারে। স্বাস্থ্যের পক্ষে কোন প্লাস্টিক ক্ষতিকর আর কোন প্লাস্টিক তুলনায় নিরাপদ, সেটা বোঝার কিছু সহজ উপায় আছে। আজকালকার দিনে এই ব্যাপারটা সবারই জেনে রাখা দরকার।
স্বাস্থ্যের পক্ষে প্লাস্টিক কতটা ক্ষতিকর হতে পারে
প্লাস্টিকের পরিচয়
প্লাস্টিকগুলো আসলে উচ্চ আনবিক ভর যুক্ত অর্গানিক পলিমার। এগুলো তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। প্রায়শই এগুলোর সাথে নানারকম রাসায়নিক পদার্থ মেশানো থাকে। এই রাসায়নিকগুলো হামেশাই মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।
এমনিতে প্লাস্টিকের শিশি, বোতল, কৌটো, বাক্স, পট বা থালাবাসন ব্যবহারের পক্ষে দারুণ সুবিধাজনক। এগুলো হালকা অথচ মজবুত। হাত থেকে পড়ে গেলেও ভেঙে যায় না। তাছাড়া প্লাস্টিকের জিনিসপত্র দামে সস্তা ও টেকসই। কিন্তু আসল প্রশ্নটা হলো, আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে এগুলো কতোটা নিরাপদ? সত্যি কথা বলতে কি, অনেক ক্ষেত্রেই এই প্লাস্টিকের আধারগুলো নিরাপদ তো নয়ই, বরং রীতিমতো ক্ষতিকারক। |
বিপদের নাম লিচিং
কোনো প্লাস্টিকের বোতল বা পাত্রকে গরম করলে, ঘষলে, আঁচড়ালে বা চিড় ধরালে তা থেকে নানারকম অপকারি যৌগ বেরোতে থাকে। একে বলে লিচিং। কোনো কোনো প্লাস্টিকের পাত্র থেকে সাধারণ অবস্থাতেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা (মাইক্রোবিডস) ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। এগুলো সহজেই পাত্রে রাখা খাবার বা জলে মিশে যায়।
স্বাভাবিকভাবেই এ জাতীয় প্লাস্টিকের আধার থেকে দীর্ঘদিন খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হতে পারে। যেমন, এর ফলে দেহে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। কমে যেতে পারে রোগপ্রতিরোধ শক্তি। এছাড়াও এর ফলে ঘটতে পারে প্রজনন স্বাস্থ্যের হানি, লিভারের সমস্যা সহ আরো নানান রোগ।
বিসফেনলের বিষ
প্লাস্টিক নিঃসৃত অপকারি রাসায়নিক পদার্থগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত হলো বিসফেনল-এ (Bisphenol-A)। এটা কার্সিনোজেনিক, অর্থাৎ, ক্যানসার-সৃষ্টিকারী পদার্থ। এছাড়াও স্বাস্থ্যের ওপর বিসফেনলের আরো অনেক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে বাচ্চাদের পক্ষে। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, অনিরাপদ প্লাস্টিকের বোতল বা পাত্র থেকে নিয়মিত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করলে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই কারণে যে কোনো প্লাস্টিকের আধার স্বাস্থ্যের পক্ষে যথেষ্ট নিরাপদ কি না সেটা আগেই যাচাই করা উচিত।
প্লাস্টিক পাত্র নিরাপদ না ক্ষতিকর, ধরার উপায়
আরআইসি চিহ্ন
স্বাস্থ্যের পক্ষে কোনো প্লাস্টিকের পাত্র নিরাপদ না অনিরাপদ তা বোঝার একটা সহজ উপায় আছে। সেটা হলো পাত্রের গায়ে থাকা বিশেষ ত্রিকোণ চিহ্নটা লক্ষ্য করা। সাধারণত, এই চিহ্নটা যে কোনো প্লাস্টিক বোতল বা পাত্রের তলার দিকে থাকে। এই চিহ্নটার পোশাকি নাম আরআইসি বা রেসিন আডেনটিফিকেশান কোড (Resin Identification Code)। কোনো প্লাস্টিক পাত্রের গায়ে এই চিহ্নটা দেখতে না পেলে সেটাকে প্রথমেই বাতিল করে দিতে হবে।
প্লাস্টিকের আরআইসি চিহ্ন দেখতে একটা ত্রিভুজের মতো। ত্রিভুজটা তিনটে বাঁকানো তীর দিয়ে তৈরি। এই ত্রিভুজের মধ্যে থাকে ১ থেকে ৭-এর মধ্যে কোনো একটা সংখ্যা। এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটা চিহ্ন, যার সাহায্যে আপনি জেনে নিতে পারেন যে কোনো প্লাস্টিকের আসল পরিচয়।
প্লাস্টিক পণ্যের আরআইসি চিহ্ন
➤ আরআইসি নম্বর ১: ত্রিভুজের মধ্যের সংখ্যাটা যদি ১ হয়, তবে জানবেন পাত্রের প্লাস্টিকটা হলো পিইটি (PET) বা পলিইথিলিন টেরাফথ্যালেট। এ ধরনের প্লাস্টিককে কিছুটা নিরাপদ বলেই গণ্য করা হয়। তবে এ ধরণের প্লাস্টিকের পাত্রে ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য ক্ষতিকর অনুজীব সহজেই বাসা বাঁধে। তাই এই প্লাস্টিকের তৈরি বোতল বা পাত্র একবারের বেশি ব্যবহার করল ক্ষতি হতে পারে।
➤ আরআইসি নম্বর ২: ত্রিভুজের মধ্যের সংখ্যাটা ২ হলে বুঝতে হবে ঐ প্লাস্টিকটা এইচডিপিই (HDPE) বা হাই ডেনসিটি পলিইথিলিন। এগুলো বেশ মজবুত। এ জাতীয় প্লাস্টিকের পাত্র থেকে খাদ্য বা পানীয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশে যাওয়ার ভয় কম, যদি না আপনি পাত্রটাকে গরম করতে যান। এ জাতীয় প্লাস্টিকের বোতল বা পাত্রকে খাদ্য ও পানীয় রাখার কাজে অনেকটাই নিরাপদ বলে মনে করা হয়।
➤ আরআইসি নম্বর ৩: ত্রিভুজের মধ্যে ৩ সংখ্যাটা দেখলেই আপনাকে হুঁশিয়ার হতে হবে। ঐ প্লাস্টিক পিভিসি (PVC) বা পলিভিনাইল ক্লোরাইড। পিভিসি স্বাস্থ্যের পক্ষে যথেষ্ট নিরাপদ নয়, বরং বেশ ক্ষতিকর। এরকম প্লাস্টিকের আধার পানীয় বা খাদ্যবস্তু রাখার কাজে ব্যবহার না করাই ভালো।
➤ আরআইসি নম্বর ৪ ও ৫: ত্রিভুজের মধ্যের সংখ্যাটা যদি হয় ৪ তবে বুঝতে হবে ঐ প্লাস্টিক এলডিপিই (LDPE) বা লো ডেনসিটি পলিইথিলিন। সংখ্যাটা ৫ হলে বুঝতে হবে প্লাস্টিকটা পিপি (PP), অর্থাৎ পলিপ্রপিলিন। জল, খাদ্য ও পানীয় রাখার জন্য এই দুটো প্লাস্টিককেই তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়।
➤ আরআইসি নম্বর ৬ ও ৭: ত্রিভুজের মধ্যের সংখ্যাটা ৬ হলে আপনি জানবেন ঐ প্লাস্টিকটা হলো পিএস (PS) বা পলিস্টাইরিন। আর সংখ্যাটা ৭ হলে বুঝতে হবে প্লাস্টিকটা নাইলন, অ্যাক্রিলিক, পলিকার্বোনেট বা অন্য কিছু। ৬ ও ৭ চিহ্নিত সব প্লাস্টিকই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। জল বা খাদ্যবস্তু রাখার কাজে এ ধরণের প্লাস্টিকের তৈরি বোতল বা অন্য কোনো আধার একেবারেই ব্যবহার করা চলবে না।
আরও দুটো বিশেষ চিহ্ন
আরআইসি চিহ্ন ছাড়াও প্লাস্টিক পণ্যের গায়ে বা লেবেলে আরো কিছু চিহ্ন থাকতে পারে। জিনিসটা নিরাপদ কিনা বুঝতে এগুলোও কিছুটা সাহায্য করে। এরকম একটা চিহ্ন হলো “কাপ ও কাঁটাচামচ”। এটা বোঝায় প্লাস্টিকের পাত্রটা খাদ্য রাখার পক্ষে নিরাপদ। পণ্যের গায়ে বা লেবেলে “BPA Free” (বিসফেনল-এ মুক্ত) উল্লেখ করা থাকলেও সেটাকে খাদ্যবস্তু রাখার কাজে অনেকটা নিরাপদ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
এরপরেও যদি কোনো প্লাস্টিক পাত্র স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ কিনা সে ব্যাপারে আপনার সংশয় থাকে তবে লেবেল দেখে নির্মাতার কাস্টমার কেয়ার নাম্বারটা বের করুন ও সরাসরি প্রশ্ন করুন। সতর্ক উপভোক্তাই যে সুরক্ষিত উপভোক্তা, এটা তো আপনার জানাই আছে।
দরকার বিশেষ সতর্কতা
খাদ্য ও পানীয় রাখার কাজে কোন প্লাস্টিক কতটা নিরাপদ জানলেন। অনিরাপদ বা ক্ষতিকর প্লাস্টিক বাদ দিয়ে তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ প্লাস্টিক বেছে নিলেন। তারপরেও কিন্তু আপনাকে প্লাস্টিকের ব্যাপারে কয়েকটা নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেমন—
- প্লাস্টিক পাত্রে জল বা খাবার গরম করা বা গরম খাবার রাখা চলবেনা। গরম জল, গরম চা বা অন্য কোনো গরম পানীয়ও কোনো প্লাস্টিক বোতলে রাখা চলবে না। গরম জল দিয়ে এধরনের পাত্রকে ধোয়া চলবে না। শীতকালে প্লাস্টিকের বোতলে পানীয় জল রেখে রোদে গরম করাও ঠিক নয়।
- নির্মাতা সংস্থা যদি প্লাস্টিক পাত্রকে মাইক্রোওয়েভেবল বলে দাবি করে তাও সেটাকে খাবার গরম করার কাজে লাগানো উচিত নয়। কারণ, একটা প্লাস্টিকের আধার মাইক্রোওয়েভেবল বলতে বোঝায় সেটাকে মাইক্রোওয়েভে রেখে গরম করা টেকনিকালি সম্ভব (বেঁকে যাবে না বা গলে যাবে না)। কিন্তু এটা বোঝায় না যে সেটাতে খাবার গরম করাটা স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ। মনে রাখতে হবে, গরম অবস্থায় যে কোনো প্লাস্টিক থেকে লিচিং বেড়ে গিয়ে খাদ্যে ও পানীয়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থগুলো বেশি করে মিশে যায়।
- প্লাস্টিকের বোতল বা পাত্রে কোনো আম্লিক পদার্থ, যেমন, লেবুর রস, কাটা টমেটো, ভিনিগার, টকজাতীয় ফলের রস, ইত্যাদি রাখা চলবে না।
- প্লাস্টিক পাত্র ডিশওয়াশারে ধোয়া ঠিক নয়। হালকা ডিটারজেন্টের সাহায্যে এগুলোকে হাত দিয়ে ধুয়ে বাতাসে রেখে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
- খাদ্যবস্তু সংরক্ষণে প্লাস্টিক শিশি, বোতল, কৌটোর ব্যবহার যদি আপনি চালিয়ে যেতে চান তবে সেটা বিস্কুট, চিপস ও অন্যান্য শুকনো খাবার রাখার কাজেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো।
প্লাস্টিকের বিকল্প নিরাপদ বস্তু ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো
এতো ক্ষণ প্লাস্টিক পাত্রের যেসব চিহ্নের কথা বললাম, সেগুলো কিন্তু সবই নির্মাতাদের বক্তব্য। এগুলোকে চোখ বুঁজে বিশ্বাস করাও বোধহয় ঠিক নয়। তাছাড়া বাজারে নকল মালের ছড়াছড়ি, সেটাও ভুললে চলবে না। আর সত্যি কথাটা হলো, স্বাস্থ্যের পক্ষে কোনো প্লাস্টিকই ১০০ শতাংশ নিরাপদ নয়। পরিবেশের পক্ষেও প্লাস্টিক ভালো নয়। তাই জল, খাবার ও অন্যান্য পানীয় রাখার জন্য প্লাস্টিক ব্যবহার না করলেই সবচেয়ে ভালো। সেক্ষেত্রে ভালো বিকল্প কী, জানতে চান? প্লাস্টিকের নিরাপদ বিকল্প বস্তুগুলো হলো স্টেইনলেস স্টিল, কাচ, চিনামাটি, পোড়ামাটি, উদ্ভিদ্জ বস্তু (শালপাতা, কলাপাতা), ইত্যাদি। স্বাস্থ্যের পক্ষে এগুলো সবই প্লাস্টিকের চেয়ে শতগুণ নিরাপদ। খাদ্য-পানীয়ের স্বাদ-গন্ধ-গুণমান সবই এগুলোতে অনেক ভালো থাকে। এই ব্যাপারটা নিজেই পরখ করে দেখতে পারেন। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]