প্রকৃতিতে বেশিরভাগ গাছ মানুষের পক্ষে উপকারি হলেও কিছু ক্ষতিকর গাছও রয়েছে। পার্থেনিয়াম তেমনই এক ক্ষতিকর গাছ। অল্পস্বল্প নয়, এগাছ মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশ্বের অতি বিপজ্জনক সাতটা আগাছার মধ্যে পার্থেনিয়াম একটা। আজকাল প্রায় সব জেলাতে এই বিষাক্ত আগাছা ব্যাপকভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অনেক জায়গায় মানুষের বসতির চারপাশে, খোলা মাঠে, এমনকি চাষযোগ্য জমিতেও পার্থেনিয়াম গিজগিজ করছে। যে সব জায়গা আগে ভৃঙ্গরাজ, কালমেঘ, তুলসি ইত্যাদি নানা ঔষধিগুণ যুক্ত গাছগাছড়ার দখলে ছিলো সেখানে এখন রাজত্ব করছে আগাছা পার্থেনিয়াম। এই আগাছা দমনের কাজে অবিলম্বে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
পার্থেনিয়ামের আগমন বৃত্তান্ত |
ভারতে পার্থেনিয়ামের আগমন ১৯৫০-এর দশকে, উৎপত্তিস্থল আমেরিকা মহাদেশ থেকে গম আমদানির মধ্য দিয়ে। তারপর এটা ক্রমশ পশ্চিম থেকে পূর্ব ভারতে বিস্তার লাভ করে। এগাছ এখন ভারত ও বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এমনিতে পার্থেনিয়াম স্বল্পজীবী গাছ। কিন্তু হলে হবে কী, এর বংশবিস্তার ক্ষমতা অসাধারণ। এই জন্য একে রোখা দারুণ কঠিন। |
পার্থেনিয়াম: উদ্ভিদ পরিচয়
পার্থেনিয়াম গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Parthenium hysterophorus L.। এই গাছ পুরোপুরি বাড়লে ১ থেকে ১.৫ মিটার উঁচু হতে পারে। পার্থেনিয়ামের পাতা দেখতে অনেকটা গাজর গাছের পাতার মতো। এই কারণে অনেক জায়গায় এই গাছকে গাজর ঘাস নামে ডাকা হয়। পার্থেনিয়ামের ফুল আকারে ছোটো, রঙ সাদা, ফোটে প্রচুর সংখ্যায়। ফুলের চূড়ান্ত পরিণতি হয় বীজে। এক একটা গাছ থেকে ১০০০০ থেকে ১৫০০০ বীজ তৈরি হতে পারে। বীজগুলো খুবই ছোটো। এগুলো বাতাসে ভেসে অনেকদূর ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া সেচের জলে মিশে, গবাদি পশুর গোবরের মাধ্যমে, মানুষের পায়ে পায়ে ও গাড়ির চাকার কাদামাটির সাথে মিশেও পার্থেনিয়ামের বীজ দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
পার্থেনিয়াম গাছ
পার্থেনিয়াম গাছের সব অংশে sesquiterpene lactone জাতীয় নানা রকম ফাইটোটক্সিন বা উদ্ভিজ্জ বিষ থাকে। তার মধ্যে একটা হলো পার্থেনিন। এই সব বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতির কারণে এই গাছ মানুষ ও জীবজন্তুর পক্ষে বিশেষ ক্ষতিকর।
পার্থেনিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাব
পার্থেনিয়ামকে বলা হয় আগ্রাসী প্রজাতি। পড়শি গাছেদের ক্ষতি করতে এই গাছ ওস্তাদ। এগাছ বিশেষ কিছু রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে আশেপাশের অন্যান্য গাছপালার অঙ্কুরোদ্গম, বৃদ্ধি ও প্রজননকে দমিয়ে দেয়। উদ্ভিদবিজ্ঞানে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় অ্যালিলোপ্যাথি। পার্থেনিয়াম হলো অ্যালিলোপ্যাথির মাস্টার। এগাছকে অবাধে বাড়তে দেওয়া মানে তাই দেশজ গাছপালা ও কৃষিজ ফসলের বিপদ ডেকে আনা। খেতের পাশে গজিয়ে ওঠা পার্থেনিয়ামের দূষণ থেকে ফসলের উৎপাদন কমে যেতে পারে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বিশেষ করে ধান, গম, ভুট্টা, সর্ষে, ছোলা, বেগুন, টমেটো, লংকা, ইত্যাদি ফসলের পক্ষে এগাছ এক বিপদ স্বরূপ।
গবাদি পশুদের পক্ষে পার্থেনিয়াম দারুণ ক্ষতিকর। এগাছের মধ্যে চরলে বিষক্রিয়ার ফলে তাদের চামড়া ফুলে যায়। দেখা দেয় চর্মরোগ। এগাছ খেয়ে ফেললে গরু, মোষ ও ছাগলের খাদ্যনালির সমস্যা, ডাইরিয়া ও জ্বর হতে পারে। এর ফলে তাদের প্রজনন শক্তি ও দুধ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। তাছাড়া, দুধেল গরু-মোষ এই গাছ খেলে তাদের দুধ তেতো হয়ে যায়। বাছুর সেই দুধ খেলে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সেই দুধ মানুষ খেলে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভবনা থাকে।
পার্থেনিয়ামের অপকারিতা মানুষের জন্যও কম নয়। এগাছের কাছাকাছি এলে বা ছোঁয়া লাগলে মানুষের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। দেখা দিতে পারে—
- জ্বর,
- মাথাব্যথা,
- উচ্চ রক্তচাপ,
- ডাইরিয়া,
- চোখ জ্বালা,
- চামড়া লাল হয়ে যাওয়া,
- চামড়া ফুলে যাওয়া,
- চুলকানি,
সহ নানান উপসর্গ। হতে পারে একজিমাও। পার্থেনিয়ামের প্রভাবে অনেকের মধ্যে এক ধরনের জটিল চর্মরোগ তৈরি হয়। এর নাম পার্থেনিয়াম ডার্মাটাইটিস। এছাড়াও এই গাছ থেকে মানুষের হাঁপানি, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, হে ফিভার সহ নানা রকম রোগব্যাধি দেখা দিতে পারে। সব ক্ষেত্রেই শিশুদের বিপদের আশংকা সবচে' বেশি।
পার্থেনিয়াম দমন পদ্ধতি
বিষাক্ত পার্থেনিয়াম গাছ দমন করা বিরাট কিছু কঠিন কাজ নয়। এগাছ দমনের বেশ কয়েকটা পদ্ধতি আছে।
১) বিষ প্রয়োগে দমন [Not Recommended]: Paraquat জাতীয় রাসায়নিক বিষ স্প্রে করে পার্থেনিয়াম দমন করা যায়। কিন্তু এধরনের বিষ মানুষ ও পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই আমরা এই পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছি না।
২) কেরোসিন তেল ছিটিয়ে দমন: কেরোসিন তেলে ছিটিয়ে পার্থেনিয়াম গাছ নিধন করা যায়। তবে এটা খরচসাপেক্ষ। তাছাড়া কেরোসিন মাটির পক্ষে খারাপ, আশেপাশের জলাশয়ের জলে মিশে গেলে আরও খারাপ। তাই এটাও ভালো পদ্ধতি নয়।
৩) আগুনের সাহায্যে দমন: পার্থেনিয়াম গাছ নষ্ট করার একটা সহজ উপায় আগুন লাগিয়ে এই গাছের ঝোপঝাড় পুড়িয়ে দেওয়া। এটা কার্যকর পদ্ধতি। তবে এই পদ্ধতির একটা নেতিবাচক দিক আছে। গাছ পোড়ানোর সময়, হাওয়ার সাথে গাছের রেণু ও বীজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এগুলো থেকে কাছাকাছি থাকা মানুষ ও পশুপাখির সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া আগুন থেকে মাটির কিছুটা ক্ষতি হয়।
৪) জৈব পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ: বিশেষজ্ঞদের মতে নানা রকম পাতাখেকো পোকামাকড়ের সাহায্যে পার্থেনিয়াম গাছ দমন করা সম্ভব। এই পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে এটা এখনো তেমন ভাবে প্রচলিত হয় নি।
৫) লবণজল প্রয়োগ: এই পদ্ধতি পার্থেনিয়াম দমনের অন্যতম চালু পদ্ধতি। এক্ষেত্রে লবণ জলের ঘন দ্রবণ (প্রতি ৪ লিটার জলে ১ কেজি নুন গুলে তৈরি করতে হবে) গাছের ওপর ছেটাতে হবে। এর দুতিন দিনের মধ্যে গাছ মরে যাবে।
৬) পার্থেনিয়াম দমন করার সবচেয়ে কার্যকরি ও পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতি হলো গাছ কেটে মাটি চাপা দেওয়া। এক্ষেত্রে গোটা এলাকার পার্থেনিয়াম গাছ গোড়া থেকে কেটে গভীর গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিতে হবে। গাছ কাটার সময় হাতে গ্লাভস, মুখে মুখোশ, চোখে চশমা এবং গা-হাত-পা পুরোপুরি ঢাকা পোশাক পরতে হবে। মাথাও গামছা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। পুরো অপারেশনটা চালাতে হবে ধীরেসুস্থে, তাড়াহুড়ো করা চলবে না। কাজ শেষে কর্মীদেরকে সব পোশাক পরিচ্ছদ ধুয়ে, নিজেরা স্নান করে বাড়িতে ঢুকতে হবে।
পার্থেনিয়াম দমনে চাই জরুরি পদক্ষেপ
ক্ষতিকর আগাছা পার্থেনিয়াম সম্পর্কে এখনো অনেক মানুষের কোনো সচেতনতা নেই। এ ব্যাপারে প্রশাসন উপযুক্ত গুরুত্ব না দিলে জন সচেতনতা গড়ে উঠবেই বা কী করে? বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন ও বেহিসাবি বৃষ্টিবাদলের সুযোগে এগাছ নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। এই বিপদকে আর উপেক্ষা না করে পার্থেনিয়াম দমনে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া, এই গাছকে জৈব সার তৈরি, জৈব কীটনাশক উৎপাদন, বায়োগ্যাস উৎপাদন, ওষুধ তৈরি, ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা সম্ভব কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।
অনেক জায়গায় সেচ্ছাসেবি সংগঠনগুলি পার্থেনিয়াম দমনের লক্ষ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সচেতন নাগরিকরা নিজেরা ব্যক্তিগত স্তরে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। কিন্তু পার্থেনিয়ামের বিপদ দূর করতে আরো অনেক তৎপরতা দরকার। সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। বিশেষ করে স্থানীয় স্তরে পুর ও পঞ্চায়েত প্রশাসনকে এই আগাছার নির্মূলীকরণে সক্রিয় হওয়া দরকার। না হলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠবে। তখন হয়তো আফশোষ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]