বিস্ময় বৃক্ষ রেডউড | বিশ্বের উচ্চতম গাছ

বিস্ময়কর রেডউড বৃক্ষ যাদের মধ্যে আছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গাছ ।

পৃথিবীতে এমন কিছু অসাধারণ গাছ আছে যাদের কথা জানলে অবাক হতে হয়। রেডউড গাছ এমনই এক বৃক্ষ প্রজাতি। আকাশছোঁয়া উচ্চতার এই গাছ উদ্ভিদ জগতের এক সুপারস্টার। সাইপ্রেস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম Sequoia sempervirens। উত্তর আমেরিকা মহাদেশে ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলের গহন বন গাছগুলির খাসতালুক। এই বনেরই একটি রেডউড বৃক্ষ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গাছ হিসেবে স্বীকৃত।

বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষ তুরস্কের সুলতান কোসেন, উচ্চতা ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি। প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা নীলতিমির দৈর্ঘ্য মোটামুটি ১০০ ফুট। আমাদের চেনা গাছগুলোর মধ্যে নারকেল বা তাল জাতীয় গাছ বেশ লম্বা হয়। তাও একটা নারকেল গাছের উচ্চতা মেরেকেটে শ খানেক ফুট পর্যন্ত হতে পারে। জঙ্গলের খুব পুরোনো শাল গাছও ১৫০/১৬০ ফুটের বেশি উঁচু হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু রেডউড গাছ এদের চেয়ে অ-নে-ক লম্বা।

আকাশ ছোঁয়া রেডউড গাছ

ক্যালিফোর্নিয়ার আদিম অরণ্যে এক একটা পুরোনো রেডউড গাছের উচ্চতা ৩০০ ফুট, এটা নেহাতই মামুলি ব্যাপার। ৩০০ ফুট মানে, সবচেয়ে উঁচু যে নারকেল গাছ, তারও প্রায় ৩ গুণ। অর্থাৎ, মোটামুটি ৩০ তলা বাড়ির সমান। জঙ্গলের উচ্চতম রেডউড গাছগুলি এতোটাই লম্বা। ঝকঝকে পরিষ্কার দিনেও মাটিতে দাঁড়িয়ে এদের মগডাল স্পষ্ট দেখা যায় না। কী ভাবছেন? গাছ না বলে এদেরকে বৃক্ষসম্রাট বললেই ঠিক হয়, তাইনা? দাঁড়ান বন্ধু, আসল বৃক্ষসম্রাটের সাথে আপনার এখনো পরিচয়ই হয়নি। এবার সেই মহান রেডউড বৃক্ষটির সাথে আমরা আপনার পরিচয় করাবো।

বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গাছ

আসলে ৩০০ ফুট একটা গড় মাত্র। কোনো কোনো রেডউড গাছ এর চেয়েও অনেক বেশি লম্বা। এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে উঁচু যে রেডউড গাছটির খোঁজ পাওয়া গেছে তার উচ্চতা ৩৮০.১ ফুট। সসম্মানে গাছটিকে একটি রাজকীয় নামও দেওয়া হয়েছে— হাইপেরিওন। হাইপেরিওন মহাশয়ের সাথে এঁটে উঠতে না পারলেও বনের সবচেয়ে উঁচু গাছ হওয়ার প্রতিযোগিতায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আরো কয়েকটি বিশালাকার রেডউড বৃক্ষ। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • হেলিওস (৩৭৪.৩ ফুট),
  • ইকারাস (৩৭১.২ ফুট), এবং
  • ডায়ডালাস (৩৬৩.৪ ফুট)।

বিস্ময়-বৃক্ষ রেডউড

রেডউড গাছেদের কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য

শিকড়

পরিণত রেডউড গাছগুলির উচ্চতা যখন আকাশছোঁয়া, তখন এগুলির শিকড়ও নিশ্চয় পাতালগামী হবে। ঠিক? না, ভুল। মজা হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু গাছগুলির শিকড় কিন্তু মাটির মাত্র ৬ থেকে ১২ ফুট গভীরে প্রবেশ করে। ভাবছেন, তাহলে এক একটা সুউচ্চ রেডউড গাছ কীভাবে বছরের পর বছর ঝড়-তুফান সামলে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে?

আসলে রেডউড গাছগুলির শিকড় মাটির খুব বেশি গভীরে না ঢুকলেও পাশের দিকে অনেক দূর ছড়িয়ে যায়। একটি পূর্ণবয়স্ক রেডউড গাছ নিজের চারপাশে প্রধান মূল থেকে ১০০ ফুট দূর পর্যন্ত পার্শ্বমূল ছড়িয়ে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, আশেপাশের অন্যান্য গাছের শিকড়বাকড়ের সাথে মিলে এগুলো তৈরি করে বৃক্ষমূলের এক ঠাসবুনোট জাল। এটাই রেডউড প্রজাতির সুউচ্চ গাছগুলির বছরের পর বছর মাটিতে খাড়া হয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকার আসল রহস্য।

ছাল

রেডউড গাছগুলির একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো গুঁড়ির ছাল। লালচে রঙের এই ছাল প্রায় ১ ফুট পর্যন্ত পুরু হতে পারে। কান্ডের পুরু ছাল দাবানলের আগুন থেকে এই গাছগুলিকে রক্ষা করে। (সাধারণত প্রতি বছরই ক্যালিফোর্নিয়ার বনাঞ্চলে গ্রীষ্মকালে দাবানলের প্রকোপ দেখা যায়।) তাছাড়া, রেডউড বৃক্ষের ছালে থাকা ট্যানিন জাতীয় নানান উপক্ষার ক্ষতিকর পোকামাকড়দের দূরে রাখতেও সাহায্য করে।

প্রাণবৈচিত্র

আকাশছোঁয়া উচ্চতার এক একটি রেডউড গাছ যেনো এক একটি আস্তো বাস্তুতন্ত্র। এই গাছগুলির উঁচু ডালে জমে ওঠা ধুলোমাটির আস্তরণে জন্মায় আরো অনেক গাছ। এ ধরণের গাছকে বলা হয় এপিফাইট বা পরাশ্রয়ী গাছ। দেখা গেছে, সবচেয়ে উঁচু রেডউড গাছগুলির ওপর যেসব পরাশ্রয়ী গাছ জন্ম নিয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকগুলি নিজেরাই বৃক্ষজাতীয়। এদের মধ্যে আছে নানা প্রজাতির স্প্রুস, ফার ও লরেল। এই পরাশ্রয়ী বৃক্ষগুলির এক একটি প্রায় ৪০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ছাড়াও রেডউড গাছগুলিকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে অসংখ্য পোকামাকড়, ওয়র্ম, পাখপাখালি, স্যালামান্ডার, এমনকি স্তন্যপায়ী প্রাণী।

রেডউড গাছের প্রাচীনতা

কেবল উচ্চতার জন্য নয়, রেডউড গাছগুলি তাদের প্রাচীনতার জন্যও বিখ্যাত। এই প্রজাতির গাছ ২০০০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকতে পারে। বর্তমানে জীবিত রেডউড গাছগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন গাছটির বয়স অন্তত ২২০০ বছর বলে ধারণা করা হয়। ক্ষতিকর জীবাণু, ছত্রাক ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম হওয়াতেই রেডউড গাছ দীর্ঘ কাল বেঁচে থাকতে পারে।

নবীন রেডউড বন

রেডউড গাছের বিশেষ গুরুত্ব

অন্য যে কোনো বনের তুলনায়, রেডউড বৃক্ষের বন বাতাস থেকে অনেক বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করতে পারে। হিসেব করে দেখা গেছে, প্রতি হেক্টর রেডউড বন ২৬০০ মেট্রিক টন কার্বন মাটিতে আবদ্ধ করে রাখে [treehugger]। পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তাই রেডউড গাছেরা মানুষের খুব বড়ো বন্ধু। কিন্তু মানুষ কি সেই বন্ধুদের প্রতি ন্যায্য ব্যবহার করেছে? ইতিহাস কী বলে?

বিস্ময়-বৃক্ষের বিপন্নতা

মাত্র কয়েক শ বছর আগেও ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে লক্ষ লক্ষ একর জমিতে রেডউড গাছের রাজত্ব ছিলো। স্থানীয় আদিবাসীরা এই গাছগুলিকে সমীহ করতেন, বনজঙ্গল বাঁচিয়ে রাখতেন। ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের আগমনের সাথে সাথে রেডউড গাছের গণহত্যা শুরু হয়। ১৮৫০-এর দশকে আমেরিকায় শুরু হয় গোল্ড রাশ। সে সময় হাজার হাজার ভাগ্যান্বেষী সোনার খোঁজে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে বনপাহাড়। তখন থেকে কাঠের লোভে অগুণতি সুউচ্চ রেডউড গাছকে নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে।

বর্তমানে আমেরিকায় সেই আদি রেডউড বনের মাত্র ৫ শতাংশ টিকে আছে। এখন অবশ্য এই বনভূমির সংরক্ষণে আমেরিকার সরকার অনেকটা উদ্যোগী হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার রেডউড বনে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গাছ হাইপেরিওনের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সরকারি নির্দেশে গোপন রাখা হয়েছে। গুপ্ত রাখা হয়েছে হেলিওস, ইকারাস, ডায়ডালাসদের মতো আরো কয়েকটি সুউচ্চ রেডউড গাছের অবস্থান। পর্যটকদের উপদ্রব ও বৃক্ষনিধনকারীদের হামলা থেকে গাছগুলিকে বাঁচাতেই এমন সিদ্ধান্ত। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]