ফুলের রাণী গোলাপ ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। গোলাপ ফুল ছাড়া প্রেম দিবস ভাবাই যায় না। তবে এ ফুলের তাৎপর্য শুধু এটুকুই নয়। প্রতিটি রঙের গোলাপ ফুল আলাদা গুরুত্ব বহন করে। লাল গোলাপ প্রেমের, হলুদ গোলাপ বন্ধুত্বের, সাদা গোলাপ শুদ্ধতার, কমলা গোলাপ কামনার, গোলাপী গোলাপ আনন্দের ও বেগুনি গোলাপ আভিজাত্যের প্রতীক। গোলাপ পৃথিবীর জনপ্রিয়তম ফুল। গোলাপ ফুল সম্পর্কে বিচিত্র তথ্য জানলে অবাক হতে হয়।
অতুলনীয় গোলাপ ফুল
গোলাপ ফুল সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই এর রঙ ও রূপের কথা বলতে হয়। পৃথিবীর সুন্দরতম ফুলগুলোর মধ্যে গোলাপ একটা। এ ফুল যে কতো রঙের হতে পারে তা বলে শেষ করা যাবে না। লাল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি, সাদা, কমলা, এসব তো আছেই। আজকাল আবার এমন সব হাইব্রিড গোলাপ ফোটানো হচ্ছে যেগুলোতে একই ফুলের পাপড়িতে একাধিক রঙ।
তবে কালো গোলাপ বলে কিছু হয়না। কালো গোলাপ হিসেবে যে ফুল পরিচিত তার রঙ আসলে খুব ডিপ লাল। নীল গোলাপও স্বাভাবিক নয়। ওটা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কারিকুরি। গোলাপে অন্য গাছ থেকে ডেলফিনিডিন (Delphinidin) নামক রঞ্জক জিন ঢুকিয়ে নীল গোলাপ ফুল তৈরি করা হয়।
বিভিন্ন জাতের গোলাপ গাছের ফুলের আকারে তফাত আছে। এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড়ো গোলাপ ফুলটা ফুটেছে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায়। গোলাপী রঙের এই ফুলটার ব্যাস ছিলো প্রায় ৩৩ ইঞ্চি। অন্যদিকে সবচেয়ে ছোটো গোলাপ ফুলের এক একটা কুঁড়ির আয়তন চালের দানার চেয়েও ছোটো। গোলাপ ফুলে সিট্রোনেলল, গেরানিয়ল, নেরল ইত্যাদি সুগন্ধী অ্যালকোহল জাতীয় যৌগ থাকে। এগুলোই গোলাপের মন মাতানো মিষ্টি সুবাসের জন্য দায়ি। |
গোলাপ গাছ
গোলাপ Rosaceae পরিবার ও Rosa গণের অন্তর্গত গুল্ম [Wikipedia]। পৃথিবীতে অন্তত ১০০ প্রজাতির গোলাপ গাছ আছে। প্রতিটা প্রজাতির মধ্যে আবার ফুলের রঙ ও আকার অনুযায়ী আছে অজস্র ভ্যারাইটি। সব মিলিয়ে পৃথিবীতে কম করেও ১৩০০০ ভ্যারাইটির গোলাপ ফুল আছে।
গোলাপ অতি প্রাচীন উদ্ভিদ। আমেরিকার কলোরাডোয় বন্য গোলাপ ফুলের যে প্রাচীনতম জীবাশ্ম পাওয়া গেছে তা ৩,৫০,০০,০০০ বছরের পুরোনো। গোলাপ ফুল সম্পর্কে আর একটা মজার তথ্য। আদিতে বন্য গোলাপ গাছের ফুলে মাত্র ৫টা পাপড়ি ছিলো। হাজার হাজার বছর ধরে নির্বাচিত বংশবৃদ্ধির দ্বারা আধুনিক গোলাপ ফুলে এতো পাপড়ি সম্ভব হয়েছে। বন্য গোলাপ থেকে বাগানে গোলাপ চাষের শুরু অন্তত ৫০০০ বছর পূর্বে। প্রাচীন ইরানেই প্রথম গোলাপ চাষের সূচনা বলে অনেকে মনে করেন।
বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপ গাছের আকার আয়তন একরকম নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো গোলাপের ঝাড়টা আমেরিকার অ্যারিজোনা রাজ্যে আছে। সাদা গোলাপ ফুলের এই ঝোপটার বিস্তার প্রায় ৯০০০ বর্গ ফুট। অন্যদিকে ২৩ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত গোলাপ গাছও দেখা গেছে।
সাধারণ ভাবে গোলাপ গাছ অনেক বছর বাঁচে। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন জীবিত গোলাপ গাছ জার্মানির হিলডেসহেইম শহরের গির্জায় আছে। গাছটার বয়স অন্তত ১২০০ বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির বোমায় গির্জাটা গুঁড়িয়ে গেলেও, গোলাপ গাছটা মরেনি। অসাধারণ জীবনীশক্তির এই গাছটা সারা পৃথিবীর এক বিস্ময়।
ভালোবাসার প্রতীক লাল গোলাপ ফুল
গোলাপের বংশবৃদ্ধি
গোলাপ ফুল থেকে ফল ও বীজ হতে পারে। ফলগুলো পাকলে সাধারণত লাল হয়, তবে কালো ও ডিপ পার্পেল রঙের ফলও দেখা যায়। সাধারণত বাগানের গোলাপ গাছে বীজ থেকে বংশবৃদ্ধি হয় না। গোলাপের বংশবিস্তারের পদ্ধতিগুলো হলো—
- শাখাকলম,
- দাবাকলম,
- গুটিকলম, এবং
- চোখকলম।
তবে নতুন নতুন ভ্যারাইটি সৃষ্টির জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে বীজ উৎপাদন করেও গোলাপের চারা তৈরি করা হয়ে থাকে।
গোলাপের ফল
গোলাপের ব্যবহার
গোলাপকে শুধু সৌন্দর্যের জন্য ফুল হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। গোলাপ আরো নানা কাজে লাগে। যেমন, গোলাপ ফুল থেকে তৈরি হয় উৎকৃষ্ট সুগন্ধী, গোলাপ জল, ইত্যাদি। কোনো কোনো দেশে গোলাপের ফল থেকে জ্যাম ও জেলিও তৈরি হয়। গোলাপ ভিটামিন সি সহ বেশ কিছু ভিটামিনে সমৃদ্ধ। সারা পৃথিবীতে বাগানচর্চায় উৎসাহীদের মধ্যে গোলাপ ফুলের গাছ খুবই জনপ্রিয়। [আরো পড়ুন ➤ বাগান করা: সুস্থ জীবনের সুন্দর পথ]
গোলাপেরও যুদ্ধ!
প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক গোলাপ। এহেন ফুল কি কখনো যুদ্ধ ও সেনাবাহিনীর প্রতীক হতে পারে? ইতিহাসে এমন বিচিত্র ঘটনাও ঘটেছে বৈকি। ১৫ শতকের ইংল্যান্ডে রাজত্বের দখল নিয়ে ৩২ বছর ধরে তিক্ত যুদ্ধ চলেছিলো ইয়র্ক ও ল্যান্সেস্টারের মধ্যে। যুদ্ধে ইয়র্কের প্রতীক ছিলো সাদা গোলাপ ফুল এবং ল্যান্সেস্টারের প্রতীক ছিলো লাল গোলাপ ফুল। দুই পক্ষের প্রতীক গোলাপ ফুল হওয়ায় যুদ্ধটাই ‘গোলাপের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত হয়।
তবে আজকের দিনে আমরা কখনোই চাইবো না গোলাপ ফুল হোক যুদ্ধের প্রতীক। বরং আমরা চাইবো গোলাপ ফুল হোক শুধুই ভালোবাসার প্রতীক। আমরা চাইবো ঘৃণা ও বিদ্বেষের বদলে মানুষে মানুষে ভালোবাসাই প্রস্ফুটিত হোক বিশ্বজুড়ে। ঠিক গোলাপ ফুলের ফুটে ওঠার মতোই। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]