
এই ধরাধামে এমন কিছু গাছ আছে যাদের গুণ বলে শেষ করা যায় না। অ্যালোভেরা এমনই এক অসাধারণ গাছ। বাংলায় এই গাছ ঘৃতকুমারী নামেও পরিচিত। অ্যালোভেরা গাছের যত্ন নেওয়া সহজ এবং অ্যালোভেরার উপকারিতা বহুবিধ। এই গাছ আমাদের পরম বন্ধু। সুপ্রাচীন কাল থেকে উদ্যানচর্চা, চিকিৎসাবিদ্যা ও রূপচর্চায় অ্যালোভেরার ব্যবহার হয়ে আসছে।
অ্যালোভেরা গাছ
অ্যালোভেরা (বৈজ্ঞানিক নাম Aloe Vera) বহুবর্ষজীবী চিরসবুজ গাছ। এই গাছ দেখতে খানিকটা আনারাস গাছের মতো। তবে অ্যালোভেরা আসলে লিলি জাতীয় গাছ। পৃথিবীতে এ গাছের প্রায় ২৫০ রকম ভ্যারাইটি দেখা যায়। অ্যালোভেরার আদি নিবাস আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ, মতান্তরে আরব উপদ্বীপ। সেখান থেকে এই গাছ এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এর পেছনে আছে অ্যালোভেরার অসাধারণ উপকারিতা ও গুণাগুণ।
পুরোপুরি বাড়লে অ্যালোভেরা গাছের কোনো কোনো ভ্যারাইটি ২-৩ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। এ গাছের কাণ্ড খর্ব, পাতাগুলো চওড়া, রঙ সবুজ, দেখতে সুন্দর। কোনো কোনো জাতের পাতায় সাদাটে ছিটা থাকে। অ্যালোভেরার পাতা বেশ পুরু, ভেতরে থাকে পিচ্ছিল রসালো শাঁস। পাতার ধারে থাকে ছোটো ছোটো কাঁটার সারি। অ্যালোভেরা গাছের ফুল ফোটে বসন্তকালে। কমলা বা হলুদ রঙের ফুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর। গাছের গোড়া থেকে বেরোনো চারার মাধ্যমে অ্যালোভেরার বংশবিস্তার হয়।
অ্যালোভেরা এক ধরনের সাকুলেন্ট (succulent) বা রসালো গাছ। ক্যাকটাস জাতীয় গাছেদের মতো এই গাছ বেশি জোলো পরিবেশ পছন্দ করে না। যারা বাগানে বা টবে অ্যালোভেরা গাছ রাখতে চান, তাদের এই ব্যাপারটা মাথায় রাখা দরকার। |
অ্যালোভেরার উপকারিতা
অ্যালোভেরার উপকারিতা বহুবিধ। এই গাছ পরিবেশকে সুন্দর করে। যে কোনো বাগানে সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য অ্যালোভেরা গাছ লাগানো যায়। এই গাছ ঘরের ভেতরে টবেও রাখা যায়। অ্যালোভেরা এক চমৎকার বায়ুশোধক গাছ। এই গাছ ঘরের বাতাস থেকে নানা ক্ষতিকর উদ্বায়ী জৈব যৌগ, যেমন ফরম্যালডিহাইড, বেনজিন, টলুইন, ইত্যাদি শোষণ করতে সক্ষম। এই কারণে ঘরে অ্যালোভেরা গাছ রাখলে ঘরের বাতাস শুদ্ধ থাকে। [আরো পড়ুন: ইনডোর প্ল্যান্টের উপকারিতা: গাছের গুণে বায়ু শোধন]
অতি প্রাচীন কাল থেকে ত্বকের যত্ন ও রূপচর্চায় অ্যালোভেরার বহুল ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাচীন মিশরের পুরোহিতরা অ্যালোভেরার উপকারিতা জানতেন। খ্রীষ্টপূর্ব ষোড়শ শতকের এবের্স প্যাপিরাসে অ্যালোভেরা গাছের উল্লেখ আছে। ইতিহাস বলে, মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রার রূপলাবণ্যের পেছনে ছিলো অ্যালোভেরার ম্যাজিক। খ্রীষ্টিয় প্রথম শতকের রোমান পণ্ডিত প্লিনির লেখাতেও অ্যালোভেরার উপকারিতা সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়।
ত্বকের পরিচর্যায় অ্যালোভেরার উপকারিতা অসামান্য। অ্যালোভেরার পাতা পরিষ্কার জলে ধুয়ে ওপরের খোসার মতো অংশটা ছুরি দিয়ে কেটে বাদ দিলে ভেতরে যে শাঁসলো পদার্থ পাওয়া যায় সেটাই ত্বকের যত্নে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত এই শাঁসালো অংশটা পিষে জেল বানিয়ে কাজে লাগানো হয়। গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অ্যালোভেরা পাতায় বেশ কিছু সক্রিয় ফাইটোকেমিকাল থাকে। যেমন, নানা রকম অ্যাসিটাইলেটেড ম্যানান (acetylated mannans), পলিম্যানান (polymannans), অ্যানথ্রাকুইনোন (anthraquinones), অ্যানথ্রোন (anthrones), ইত্যাদি [Wikipedia]। এই যৌগগুলি থাকার কারণেই অ্যালোভেরা রসের উপকারিতা এতো বেশি। এর মৃদু জীবাণুনাশক গুণও আছে।

অ্যালোভেরা পাতার ভেতরের শাঁসালো অংশ
ত্বকের শুষ্কতা দূর করতে অ্যালোভেরার দুর্দান্ত উপকারিতা দেখা যায়। অ্যালোভেরার রস মুখের ত্বকে লাগালে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা কমে। চামড়ায় ছোটোখাটো কাটা, পোড়া, সংক্রমণ, মেচেতার দাগ, ইত্যাদিও এই রস প্রয়োগে ভালো হয়। এই রসের মৃদু বেদনানাশক গুণ আছে। মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধির অল্পস্বল্প ব্যাথায় অ্যালোভেরা রস ত্বকের ওপর লাগিয়ে ম্যাসাজ করলে উপকার পাওয়া যায়।
অ্যালোভেরা চুলের যত্নে দারুণ কাজে লাগে। চুলের গোড়ায় অ্যালোভেরা রস সপ্তাহে দুবার লাগানো যেতে পারে। লাগিয়ে কিছুক্ষণ রেখে মাথা ধুয়ে ফেলতে হবে। এইভাবে মাথায় অ্যালোভেরা রস লাগালে খুস্কি দূর হয়। চুলের উজ্জ্বলতা বাড়ে।
মুখের স্বাস্থ্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও অ্যালোভেরার উপকারিতা আছে। অল্পস্বল্প মাড়ি ফোলা, দাঁত ব্যাথা, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া, ইত্যাদি সমস্যা অ্যালোভেরা রস প্রয়োগে ভালো হয়। এই রস মুখে নিয়ে কুলি করলে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়। অ্যালোভেরার রস দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে।
অনেকে মনে করেন অ্যালোইন (Aloin) নামক যৌগের উপস্থিতির কারণে অ্যালোভেরা পাতার রস বা সরবৎ খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। এবং এই রস নিয়মিত পান করলে যকৃত, হার্ট, রক্তসংবহনতন্ত্র ভালো থাকে। শরীর সুস্থ থাকে। তবে যে কোনো অ্যালোভেরার রস খাওয়া যায় না। এর ল্যাটেক্স বা তরুক্ষীরে এমন কিছু উপাদান আছে যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে। (অ্যালোভেরার একমাত্র বার্বাডেনসিস ভ্যারাইটির রসই পরিমিত মাত্রায় খাওয়া নিরাপদ।) খাওয়ার বদলে বাহ্যিক ভাবে ত্বকের ওপরে অ্যালোভেরার রস লাগালে বা এই রস মুখে নিয়ে কুলি করে ফেলে দিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় নেই।
অ্যালোভেরা গাছের যত্ন
অ্যালোভেরা গাছের একটা বড়ো সুবিধা হলো এই গাছের সহ্যশক্তি বেশি। তাই এর জন্য অল্প যত্নই যথেষ্ট। অ্যালোভেরা গাছ চাষ করা বা টবে লাগানো খুবই সহজ। এক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় মনে রাখতে হবে।
➤ দোঁয়াশ বা বেলে-দোঁয়াশ মাটিতে অ্যালোভেরা গাছ ভালো হয়। মাটি তৈরির সময় অল্প পরিমানে গোবর সার বা কমপোস্ট সার বা যে কোনো জৈব সার মেশানো যেতে পারে।
➤ অ্যালোভেরা গাছের জন্য জলসেচ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুকনো মাটিতে বেশি সময় থাকলে এই গাছের ক্ষতি হয়। তবে অ্যালোভেরার ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা নিয়মে জল দেওয়ার চেয়ে গাছের মাটি পরখ করে জল দেওয়া ভালো। অর্থাৎ, চোখে দেখে এবং আঙুলের ডগা দিয়ে পরীক্ষা করে যখন বোঝা যাবে যে গাছের মাটি প্রায় শুকিয়ে গেছে, তখন জল দিতে হবে। জল দেওয়ার সেরা সময় হলো ভোরবেলা।
➤ সকাল বা বিকেল বেলায় সরাসরি সূর্যের আলো পেলে অ্যালোভেরা গাছ ভালো বাড়ে। তবে দুপুর বেলার প্রখর রোদ এই গাছের জন্য ভালো নয়। প্রখর রোদে থাকলে অ্যালোভেরার পাতা হালকা বাদামী ভাব ধারণ করে। ঘরের ভেতরে টবে অ্যালোভেরা গাছ রাখলে সকালের দিকে (বা বিকেলের দিকে) অন্তত ঘন্টা চারেক একে রোদ খাওয়ানো দরকার।
➤ অ্যালোভেরা গাছে রোগ পোকার আক্রমণ ঠেকাতে কয়েকটা সাবধানতা নেওয়া দরকার। প্রথম কথা হলো, অ্যালোভেরা গাছের চারা সংগ্রহ করার সময়ই খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিত করে নিতে হবে যে গাছটা সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত। এরপর দেখা দরকার যাতে গাছটা মনের আনন্দে বেড়ে ওঠার জন্য উত্তম পরিবেশ পায়। কেবল অ্যালোভেরা বলে নয়, যে কোনো গাছের ক্ষেত্রেই এই কথাটা খাটে। গাছ যদি তার উপযুক্ত মাটি, দরকার মতো জল, প্রয়োজনীয় সূর্যালোক সহ সঠিক পরিবেশ পায়, তবে গাছের স্বাস্থ্য ও ইমিউনিটি চাঙ্গা থাকে। সেক্ষেত্রে গাছে রোগব্যাধির আক্রমণ বেশি দেখা যায় না। এই কথাটা মাথায় রেখেই অ্যালোভেরা গাছের যত্ন নিতে হবে।
➤ অ্যালোভেরা গাছে অতিরিক্ত জল দিলে গোড়া-পচা রোগ সৃষ্টি হতে পারে। এ রোগ একবার হলে গাছকে বাঁচানো মুশকিল। এ রোগ এড়ানোর উপায় হলো অ্যালোভেরা গাছের গোড়ায় কখনো জল জমতে না দেওয়া।
➤ অ্যালোভেরা গাছে কদাচিত ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিভিন্ন রোগ দেখা যায়। যেমন, অ্যালো রাস্ট নামক রোগ। এতে গাছের পাতায় বাদামী রঙের ছোপ ছোপ দাগ তৈরি হয়। অ্যালোভেরার ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগের ক্ষেত্রে রাসায়নিক বিষ প্রয়োগ করার চেয়ে জৈব পদ্ধতি অবলম্বন করা ভালো। রোগ একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত করতে পারলে, পাতার আক্রান্ত অংশ কেটে বাদ দিয়েও রোগের বিস্তার থেকে গাছকে বাঁচানো সম্ভব।
➤ অ্যালোভেরায় মিলি বাগ বা অ্যাফিড জাতীয় পোকামাকড়ের আক্রমণ ঘটলে আক্রান্ত গাছটাকে প্রথমেই অন্যান্য গাছ থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। গাছের আক্রান্ত অংশটা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা যেতে পারে। নিম তেল প্রয়োগ করলেও সুফল পাওয়া যাবে। আরেকটা পদ্ধতি হলো রাবিং অ্যালকোহল (আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল)-এ তুলো ভিজিয়ে আক্রান্ত অংশটা সাবধানে মুছে পরিষ্কার করে ফেলা। রাবিং অ্যালকোহল ওষুধের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
➤ অ্যালোভেরা গাছের যত্ন ও রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে ইউটিউবে বহু বাংলা, হিন্দী ও ইংরাজি ভিডিও পাওয়া যায়। অ্যালোভেরা চাষের ক্ষেত্রে দরকার মতো এই ভিডিওগুলোর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য ইউটিউবের সব ভিডিও-ই ভরসাযোগ্য নয়। তাই অ্যালোভেরা গাছের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব বিচার বুদ্ধি অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে।
➤ টবে অ্যালোভেরা গাছ রাখলে বছরে অন্তত একবার টবের মাটি বদলে দেওয়া দরকার।
অ্যালোভেরার বংশবিস্তার
সাধারণত অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে অফশুট বা চারা থেকে অ্যালোভেরার বংশবিস্তার হয়। পরিণত অ্যালোভেরা গাছের গোড়ার নিচের দিক থেকে এই চারাগুলো গজায়। এরকম একটা চারা তিন/চার ইঞ্চি বড়ো হলে তার চারপাশে একটু দূর থেকে মাটি সরিয়ে চারাটাকে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে আলাদা করে নিতে হবে, এমনভাবে যাতে মূল গাছের কোনো ক্ষতি না হয়। এরপর চারাটা আলাদাভাবে টবে বা মাটিতে রোপন করতে হবে। টবে অ্যালোভেরা গাছ লাগালে, টবের মাটি পরিবর্তন করার সময়ও শিকড় সমেত চারাগুলোকে ছুরি দিয়ে সাবধানে কেটে নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে লাগানো যায়।
সমাদৃত গাছ অ্যালোভেরা
অ্যালোভেরা গাছ এখন সারা বিশ্বেই সমাদৃত। অসংখ্য মানুষ এই গাছ থেকে উপকৃত হয়েছেন ও হচ্ছেন। তাছাড়া, বাণিজ্যিক ভাবেও আজকাল অ্যালোভেরা পাতার রসকে সাবান, শ্যাম্পু, ত্বক পরিচর্যার ক্রিম, লোশন, জেল, মলম, ইত্যাদি নানা রকম পণ্যে ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিঘা-কে-বিঘা জমিতে রীতিমতো চাষ হচ্ছে এই গাছ। অ্যালোভেরা গাছ সত্যিই এই সমাদরের উপযুক্ত। অ্যালোভেরার উপকারিতা এমনই যে একে উপযুক্ত স্বীকৃতি না দিয়ে আমাদের উপায় নেই। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]