তাতছে পৃথিবী, দ্রুত গলে যাচ্ছে হিমালয়ের বরফ

অস্বাভাবিক দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে হিমালয়ের বরফ

উত্তর ও দক্ষিণ মেরুকে বাদ দিলে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বরফ জমে আছে হিমালয় পর্বতমালা ও তার লাগোয়া উচ্চভূমিগুলোতে। এই কারণে এই অঞ্চলকে বলা হয় পৃথিবীর তৃতীয় মেরু। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে কেবল দুই মেরুর বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে না, তৃতীয় মেরুতে হিমালয় পর্বতমালায় জমে থাকা বরফও গলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। হিমালয়ে জমে থাকা বরফের এই অস্বাভাবিক গলন, ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জলবায়ু ও পরিবেশের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলতে চলেছে। এখানকার অধিবাসীদের পক্ষে সেটা খুব একটা মঙ্গলজনক হবে না বলেই আশংকা।

গিরিরাজ হিমালয়ের পরিচয়

অবস্থান ও আয়তন

হিমালয় দক্ষিণ এশিয়ার এক সুদীর্ঘ গিরিশ্রেণী। পশ্চিমে নাঙ্গা পর্বত থেকে শুরু করে পূর্বে নামচা বারওয়া পর্যন্ত অর্ধচন্দ্রাকারে বিস্তৃত হিমালয় প্রায় ২৪০০ কিমি দীর্ঘ। উত্তর-দক্ষিণে এর প্রসার ১৫০ থেকে ৩৫০ কিমি [wikipedia]। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের মোট আয়তন ৫,৯৫,০০০ বর্গ কিমি। হিমালয়ের বিভিন্ন অংশ ভারত, পাকিস্তান, তিব্বত (চিন), নেপাল ও ভূটানের মধ্যে ছড়িয়ে আছে।

হিমালয়ের উৎপত্তি
ভূতত্ত্বে হিমালয় এক ‘নবীন’ ভঙ্গিল পর্বত রূপে বর্ণিত। আজ থেকে ‘মাত্র’ ৫ কোটি বছর আগে ভারতীয় ও ইউরেশিয় টেকটনিক প্লেটের সংঘাতে টেথিস সাগর নামক এক আদিম সমুদ্রের তলা থেকে পলিস্তর ভাঁজ খেয়ে এই পর্বতের উথ্থান শুরু হয়। মজার কথা হলো, হিমালয়ের এই উথ্থান এখনো বন্ধ হয়নি। এখনো এই পর্বতমালাল উচ্চতা প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১ সেমি করে বেড়ে চলেছে।

হিমালয়ের ভৌগোলিক বিবরণ

হিমালয় আসলে তিনটে সমান্তরাল পর্বতশ্রেণীর সমাহার। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যথাক্রমে, শিবালিক পর্বত, মধ্য হিমালয় বা হিমাচল এবং উচ্চ হিমালয় বা হিমাদ্রি। এদের মধ্যে উচ্চ হিমালয় অগুণতি উত্তুঙ্গ তুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গ ও বড়ো বড় হিমবাহের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।

উচ্চ হিমালয়েই রয়েছে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ সাগরমাথা (ইংরাজি নাম মাউন্ট এভারেস্ট, তিব্বতি নাম চোমোলাংমা) (উচ্চতা ৮৮৫০ মি)। এছাড়া এখানকার অন্যান্য উত্তুঙ্গ শৃঙ্গগুলো হলো—

  • কাংচেনজোংঘা (উচ্চতা ৮৫৮৬ মি, পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ),
  • লোৎসে (৮৫১৬ মি),
  • মাকালু (৮৪৬৩ মি),
  • চো ওইয়ু (৮২০১ মি),
  • ধৌলাগিরি (৮১৬৭ মি),
  • মানাসলু (৮১৬৩ মি),
  • নাংগা পর্বত (৮১২৫ মি),
  • অন্নপূর্ণা (৮০৯১ মি), ইত্যাদি।

পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ গডউইন অস্টিন বা k2 (৮৬১১ মি) হিমালয় সংলগ্ন কারাকোরাম পর্বতশ্রেণীতে অবস্থিত।

বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সাগরমাথা

দক্ষিণ এশিয়ায় হিমালয়ের গুরুত্ব

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর অধিবাসীদের জীবনে হিমালয় ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। প্রথমত হিমালয় নিজেই অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির আবাস। এই বিরাট পার্বত্য অঞ্চল প্রায় ৫ কোটি মানুষেরও বাসভূমি।

এছাড়া পর্বতের নিচে বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে হিমালয়ের প্রভাব অপরিসীম। হিমালয় থেকে নেমে আসা গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র ও তাদের অসংখ্য উপনদী এখানকার সভ্যতার ধাত্রী। হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট বলে এই নদীগুলোতে সারা বছর জল থাকে। এই নদীগুলো থেকে সমভূমির মানুষ পায় কৃষিকাজের জল, পানীয় জল ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জল। হিমালয় থেকে বয়ে আনা পলি দ্বারা এই নদীগুলো সমভূমির মাটিকে উর্বর করে। এক কথায় বলতে গেলে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ জীবন, অর্থনীতি, জলবায়ু ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর হিমালয়ের প্রভাব অপরিসীম।

হিমালয়ে সঞ্চিত বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে

হিমালয়ে জমে থাকা বরফ দ্রুত গলে যেতে পারে, এমন আশংকা আগে থেকেই ছিলো। এর কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন [আরো পড়ুন: বিশ্ব উষ্ণায়ন ও তার প্রতিকার ভাবনা] সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞানীরা এটাই নিশ্চিত করেছেন।

International Centre for Integrated Mountain Development-এর বিশেষজ্ঞরা উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, গত ৪০ বছরে হিমালয়ে জমে থাকা বরফ প্রায় এক চতুর্থাংশ কমে গেছে। শুধু তাই নয়, এখানে বরফ গলে যাওয়ার হারও আশংকাজনক ভাবে বাড়ছে। উদাহরণ স্বরূপ, ২০০০ সালে হিমালয়ের হিমবাহগুলোর গলনের যে হার ছিলো আজ তা বেড়ে দুগুণ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বর্তমানে হিমালয়ের জমা বরফ বছরে প্রায় ৮০০,০০,০০,০০০ টন (৮ শ কোটি টন) করে কমে যাচ্ছে। এখানকার হিমবাহগুলোও প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ মিটার করে সঙ্কুচিত হচ্ছে। [the guardian]

শেরপাদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা

হিমালয়ের হিমাবৃত শৃঙ্গগুলোতে অভিযানে গিয়ে আজ অবধি সকলেই সফল হতে পারেন নি। অনেক হতভাগ্য পর্বতারোহী দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন বরফের রাজ্যে। তাদের মৃতদেহ বরফ চাপা পড়ে এতোদিন সেখানেই থেকে গিয়েছিলো। হিমালয়ের স্থানীয় শেরপারা জানাচ্ছেন, ইদানিংকালে পর্বতের বরফ দ্রুত গলতে থাকায় মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে আসছে বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া আরোহীদের প্রায় অবিকৃত মৃতদেহ। এমন ঘটনার মুখোমুখি হলে, শেরপারা চেষ্টা করেন, মৃতদেহটি ফিরিয়ে এনে সৎকার করার। কিন্তু দুর্গমতার কারণে অনেক সময় তা সম্ভব হয় না। তখন, তুষাররাজ্যেই তাকে আবার বরফ চাপা দিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে আসতে হয় শেরপাদের। [the wall]

পরিণতি নিয়ে আশংকা

বিজ্ঞানীদের হিসেবে, হিমালয়ের বরফ যদি এভাবে গলতে থাকে তবে ২১০০ সালের মধ্যে এখানকার জমা বরফের অর্ধেকই গলে শেষ হয়ে যাবে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে, দুই-তৃতীয়াংশ বরফও গলে যেতে পারে। যতোদিন এই বরফ গলা অতিমাত্রায় চলতে থাকবে ততোদিন, হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীগুলোতে বর্ষাকালীন বন্যার ভয় বাড়বে। পার্বত্য অঞ্চলে বাড়বে হড়পা বান ও ভূমিধ্বসের ভয়।

তারপর একসময় হিমালয়ের বরফের ভাঁড়ারে টান পড়বে। তখন দক্ষিণ এশিয়ার পূণ্যতোয়া নদীগুলোতে দেখা দেবে জলের আকাল। গোটা অঞ্চল জুড়ে নেমে আসবে অভূতপূর্ব খরা। হিমালয়ের সন্তান সুজলা সুফলা দেশগুলো তখন রুখাশুখা অনুর্বর আধা-মরু এলাকায় পরিণত হবে। এখানকার অধিবাসীদের পক্ষে সেটা যে খুব সুখকর অভিজ্ঞতা হবে না, তা এখনই বলে দেওয়া যায়। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]