বিশ্ব উষ্ণায়নে কি জেগে উঠবে বরফচাপা বিভীষিকা?

পৃথিবীর হিমশীতল এলাকাগুলোতে বরফের নিচে ঘুমিয়ে আছে সুদূর অতীতের ভাইরাস ও অণুজীবের দল। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে সেই বরফ। তার সাথেই বাড়ছে ভয়। বরফ গলে হয়তো বেরিয়ে পড়বে অতীত যুগের ঘাতক জীবাণুর দল। যদি এমন ঘটে তাহলে ঘোর বিপদ। সমূহ ক্ষতি হবে আধুনিক কালের মানুষ সহ তাবৎ জীবজন্তু, পশুপাখির। বিজ্ঞানিরা বলছেন, এই আশংকা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা।

ইতিহাসের অভিজ্ঞতা

মানবদেহ অচেনা-অজানা রোগজীবাণুর মুখোমুখি হলে পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। এর উদাহরণ আমরা ইতিহাসে পেয়েছি। আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। কলম্বাসের অভিযানের পর আমেরিকা মহাদেশের দরজা ইউরোপীয়দের কাছে খুলে যায়। এরপর কর্টেজ ও পিজারোর মতো দুর্ধর্ষ সেনাপতিদের নেতৃত্বে আগ্রাসী অভিযাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেখানকার আদি বাসিন্দাদের ওপর। আক্রমণকারীদের হাতে ধ্বংস হয়ে যায় মেক্সিকোর আজটেক, গুয়াতেমালার মায়া ও পেরুর ইনকা সভ্যতা।

ইতিহাস বলছে, আমেরিকার স্থানীয় অধিবাসীরা যেমন মারা গেছিলেন শ্বেতাঙ্গ হানাদারদের তরবারির আঘাতে, তেমনই মরেছিলেন বিদেশীদের বয়ে আনা নানান রোগজীবাণুর সংক্রমণে। এর মধ্যে ছিলো স্মল পক্স, চিকেন পক্স, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া, মিসলস, টাইফয়েড, টাইফাস, টিবি, বিউবোনিক প্লেগ ইত্যাদি। আসলে ঐ জনগোষ্ঠীগুলোর কোনো রকম পরিচিতিই ছিলো না নবাগতদের বয়ে আনা বিভিন্ন রোগজীবাণুর সাথে। এই কারণে তাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ শক্তি সেদিন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিলো ঐসব জীবাণুর সাথে লড়তে। ফলে দেখা দিয়েছিলো মহামারি। মারা গেছিলেন লক্ষ লক্ষ আদিবাসী মানুষ।

এযুগে যা হতে পারে

বিশেষজ্ঞদের মতে, আমেরিকার আদি অধিবাসীদের মতোই পরিণতি হতে পারে এযুগের মানুষ ও জীবজন্তুর। এর কারণ হিসেবে তারা দায়ি করছেন বিশ্ব উষ্ণায়নকে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আজ দ্রুত গতিতে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চল ও শীতল এলাকাগুলোর বরফ। [আরো পড়ুন ➤ বিশ্ব উষ্ণায়ন ও প্রতিকার ভাবনা] এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই সেই বরফের নিচে চাপা পড়ে থাকা ভাইরাস ও অণুজীবেরা বেরিয়ে পড়বে দল বেঁধে। ঘনিয়ে উঠবে অভূতপূর্ব বিপর্যয়। কারণ, বহু ক্ষেত্রেই ঐসব বরফচাপা অণুজীবের দল মরে যায়নি, বরং বেঁচেই আছে। এতো অসাধারণ তাদের জীবনীশক্তি!

উষ্ণায়নের ফলে দ্রুত গলে যাচ্ছে শীতল এলাকাগুলোর বরফ।

বিশ্ব উষ্ণায়নের মহা বিপদ!

ভাবুন একবার। পৃথিবীর হিমশীতল এলাকাগুলোতে বরফের নিচে শত শত বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে বিষাক্ত ছত্রাকের স্পোর। হাজার হাজার বছর ধরে ওঁত পেতে বসে আছে মারণ ব্যাকটেরিয়া। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে অজানা-অচেনা ভাইরাসের দল। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সেই বরফ যতো গলবে, ততোই এরা সুযোগ পাবে বেরিয়ে পড়ার। আর তারপর? তারপর বর্তমানের মানুষ ও জীবজন্তুকে এদের নিশানা বানানোটা হবে স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

সাম্প্রতিক ঘটনায় উদ্বেগ

বিশ্ব উষ্ণায়নে অতীত যুগের রোগজীবাণুর ফিরে আসার আশংকা যে একেবারে অমূলক নয় তার নমুনা ইতিমধ্যেই দেখা গেছে। কয়েক বছর আগের ঘটনা। সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলের ইয়ামাল উপদ্বীপে গরমকালে ঘটেছিলো এক অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ। তাতে সেখানকার পার্মাফ্রস্ট (হিমায়িত বরফ ও মাটির মিশ্রণ) গলে বেরিয়ে পড়েছিলো শতাধিক বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা কয়েকটা বল্গা হরিণের লাশ। সেগুলো থেকে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। তাতে মারা যায় একটি বালক এবং দুই হাজারেরও বেশি বল্গাহরিণ। এই ঘটনা নিয়ে সেসময় সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে গিয়েছিলো। এ নিয়ে রিপোর্ট বেরিয়েছিলো সাইন্টিফিক আমেরিকানের মতো প্রসিদ্ধ জার্নালে [Scientific American]।

ভাইরাসে ভয়

সব ধরণের রোগজীবাণুর মধ্যে আবার ভয় সবচেয়ে বেশি ভাইরাসদের নিয়ে। একে তো তারা জীব ও জড়ের মাঝামাঝি পর্যায়ের বস্তু। তার ওপর তাদের মতিগতি বোঝা বেশ কঠিন। প্রতিকূল অবস্থাতে হাজার হাজার, এমনকি লাখ লাখ বছর তারা চুপচাপ কাটিয়ে দিতে পারে। তারপর অনুকূল অবস্থা পেলে আবার পনুরুজ্জীবিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে জীবজগতের ওপর। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপারটা ঘটে কোনো ভাইরাস একবার কোনো জীবকোষকে কব্জা করতে পারলে। তখন সেটা নিমেষের মধ্যে নিজের হাজার হাজার কপি তৈরি করে ফেলতে পারে। অবশ্য ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীবদের নিয়েও ভয় কম নেই। কারণ তাদেরও রয়েছে অদ্ভুত জীবনীশক্তি।

বিজ্ঞানিদের পরীক্ষা নিরীক্ষা

অতীত কালের ভাইরাস ও অণুজীবদের নিয়ে বিজ্ঞানিরা ইতিমধ্যে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। কয়েক বছর আগে নাসার একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিলো। তাতে দাবি করা হয়, আলাস্কার এক জলাশয়ের তলায় ৩২০০০ বছর ধরে বরফচাপা পড়ে থাকা ব্যাকটেরিয়াকে বিজ্ঞানিরা সক্রিয় করে তুলতে সফল হয়েছেন। ২০১৪/১৫ সালে সাইবেরিয়ার পার্মাফ্রস্টের নিচে ৩০০০০ বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা দু রকম ভাইরাসকেও বিজ্ঞানিরা সক্রিয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের আকার সাধারণ চেনা ভাইরাসদের তুলনায় অনেকটাই বড়ো। বিজ্ঞানিরা তাদের নাম দিয়েছিলেন মলিভাইরাস ও পিথোভাইরাস [BBC Earth]।

শেষের কথা

বরফের নিচে অযুত যুগ ব্যাপী চাপা থাকা সব ভাইরাস ও অণুজীবই যে বরফ গলে গেলে সক্রিয় হয়ে উঠবে এমনটা নিশ্চয় ঘটবে না। তবে তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যকও যদি জেগে উঠে স্বমূর্তি ধারণ করে, তবে মানুষ ও জীবজন্তুর পক্ষে সেটা হবে দারুণ বিপদ। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর দুই মেরু ও হিমায়িত এলাকাগুলোর বরফ যে হারে গলে যাচ্ছে তাতে ভয়টা থেকেই যাচ্ছে। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]।