পার্মাফ্রস্ট দ্রুত গলছে, পরিণাম নিয়ে আশংকা

পার্মাফ্রস্ট গলে যাচ্ছে, বাড়ছে উদ্বেগ

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে ভূমন্ডলে এমন সব পরিবর্তন ঘটছে যা আগে কেউ কোনো দিন ভাবতেই পারেনি। যেমন ধরুন, হিমশীতল এলাকাগুলোতে পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়া। বায়ুর গড় উষ্ণতা বাড়ার সাথে সাথে এসব এলাকায় পার্মাফ্রস্টের বরফকঠিন আচ্ছাদন ক্রমশ গলে যাচ্ছে। গলে যাওয়ার হারটা আবার দিনদিন বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই এর পরিণাম নিয়ে দেখা দিয়েছে ঘোর দুর্ভাবনা।

পার্মাফ্রস্ট কী?

স্থায়িভাবে জমে থাকা জল ও মাটির মিশ্রণকে ভূবিজ্ঞানে বলা হয় পার্মাফ্রস্ট (Permafrost)। অবশ্য মাটি বলতে এখানে শুধু মাটি নয়, বালি, কাঁকড়, নুড়ি, পাথর, সবই বুঝতে হবে।

পার্মাফ্রস্ট গঠিত হয় পৃথিবীর অতিশীতল এলাকাগুলোতে। এইসব জায়গায় তাপমাত্রা প্রায়শই ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে থাকেে। এরকম জায়গায় দারুণ ঠান্ডায় ভূত্বকের জল-মাটির মিশেল, সব শুদ্ধু জমে যায়। এই মিশ্রণ অন্তত দুবছর টানা জমে থাকলে তবেই তাকে পার্মাফ্রস্ট হিসেবে ধরা হয়।

পৃথিবীতে এমন বহু জায়গা আছে যেখানে পার্মাফ্রস্ট শত শত বা হাজার হাজার বছর ধরে জমে আছে। এরকম হিমায়িত আচ্ছাদন কয়েক সেন্টিমিটার থেকে শুরু করে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু হতে পারে। সেটা পর্বত শীর্ষে অল্প জায়গায় সীমিত থাকতে পারে, আবার মেরু লাগোয়া তুন্দ্রা-র মতো বিরাট এলাকাতেও ছড়িয়ে থাকতে পারে।

পার্মাফ্রস্ট পৃথিবীর কোথায় কোথায় আছে?

ধরাপৃষ্ঠে পার্মাফ্রস্টের পরিমান নেহাত কম নয়। পার্মাফ্রস্ট আছে আন্টার্কটিকা মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। আছে কানাডা, আলাস্কা, গ্রিনল্যান্ড, উত্তর ইউরোপ ও সাইবেরিয়ার বিরাট এলাকায়। এছাড়াও খুব উঁচু পার্বত্য ভূমিতে পার্মাফ্রস্ট দেখা যায়। এর উদাহরণ, এশিয়ার হিমালয় ও তিব্বত মালভূমি, আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো, ইউরোপের আল্পস, উত্তর আমেরিকার রকি মাউন্টেন ও দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বত।

বিজ্ঞানীদের হিসেবে, মোট ভূভাগের মোটামুটি ২০ শতাংশে ছড়িয়ে আছে পার্মাফ্রস্ট। উত্তর গোলার্ধে এর পরিমান একটু বেশি, প্রায় ২৫ শতাংশ। অবশ্য এযুগে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে পার্মাফ্রস্ট যুক্ত এলাকার আয়তন ক্রমশ কমছে। গত ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে এমন এলাকা প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে।

পার্মাফ্রস্ট ও বিশ্ব উষ্ণায়ন

বর্তমানে পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ব্যাপারটা বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এর মূলে আছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবীর শীতল এলাকাগুলো আস্তে আস্তে ‘গরম’ হয়ে উঠছে। ফলে সেসব জায়গায় হিমায়িত পার্মাফ্রস্ট ক্রমশ গলে যাচ্ছে। [আরো পড়ুন: বিশ্ব উষ্ণায়ন ও তার প্রতিকার ভাবনা]

পরিণাম নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

পৃথিবীর বিস্তীর্ণ এলাকায় পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ফলাফল রীতিমতো আশংকাজনক। এর ফলে ভূমন্ডলে গভীর পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এর সম্ভাব্য পরিণামগুলো এরকম:—

১)ভূমিরূপের বদল

বরফ গলে জল হলে তার আয়তন বাড়ে না, কমে। গলনের ফলে পার্মাফ্রস্টের আয়তনও কমে যায়। এর অনিবার্য পরিণতি পার্মাফ্রস্ট এলাকার মাটি বসে যাওয়া। এ থেকে নানা মাপের গর্ত ও খাদও তৈরি হতে পারে। বন এলাকায় ভৌম পার্মাফ্রস্টের গলনে মাটির তল ক্রমাগত পাল্টে যেতে থাকে। ফলে সেখানকার গাছগুলো অনবরত নিজেদের কান্ড বাঁকাতে বাধ্য হয়। এ থেকেই সৃষ্টি হয় অদ্ভুতদর্শন ‘নৃত্যরত বন’।

নৃত্যরত বন

২)পরিকাঠামোর ক্ষতি

পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ফলে ভূমিরূপের যে বদল ঘটে তাতে পরিকাঠামোর দারুণ ক্ষতি হতে পারে। মাটি ধ্বসে বা বসে গিয়ে বিল্ডিং, সেতু, রাস্তা, রেলপথ, বিমানবন্দর ইত্যাদি ভেঙে পড়তে পারে। এতে সম্পদের ক্ষতি তো হয়ই, জীবনহানিও অসম্ভব নয়। বর্তমানে সব দেশ মিলিয়ে প্রায় ৩,৫০,০০,০০০ মানুষ পার্মাফ্রস্ট এলাকায় বাস করেন। ইতিমধ্যেই তারা বেশ ক্ষয়ক্ষতির আশংকায় আছেন। সাম্প্রতিক কালে কানাডা, রাশিয়ার সাইবেরিয়া ও আমেরিকার আলাস্কায় এধরনের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে গেছে।

৩)বিশ্ব উষ্ণায়নে গতি সঞ্চার

পার্মাফ্রস্টের মধ্যে আটকে আছে বিপুল পরিমানে কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্রিন হাউস গ্যাস। পার্মাফ্রস্ট যতো গলবে ততোই এই গ্যাসগুলো ছাড়া পেয়ে বায়ুতে মিশে যাবে। তাছাড়া পার্মাফ্রস্টের হিমায়িত মিশ্রণে চাপা পড়ে আছে অসংখ্য ম্যামথ ও অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তুর লাশ। প্রবল ঠান্ডায় এগুলোতে আজও পচন ধরেনি। কিন্তু পার্মাফ্রস্ট উষ্ণ হয়ে গলে গেলে এগুলো পচতে শুরু করবে। এর ফলেও প্রচুর পরিমানে মিথেন ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হবে। এ থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আরো বেড়ে যাবে।

৪)বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া

হিমশীতল অঞ্চলগুলোতে পার্মাফ্রস্ট গলে গেলে পৃথিবীতে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হবে। এই গলনে যে বাড়তি জল উৎপন্ন হবে, তা সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে। এ থেকে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে। এছাড়া পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ফলে স্থানীয়ভাবে যা যা ঘটতে পারে সেগুলো হলো—

  • ভূমিক্ষয় বেড়ে যাওয়া,
  • ভৌম জলের স্তর নেমে যাওয়া,
  • খরা দেখা দেওয়া,
  • দাবানলের প্রকোপ বেড়ে যাওয়া, ইত্যাদি।

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে গলছে পার্মাফ্রস্ট

বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জমে থাকা পার্মাফ্রস্ট

পার্মাফ্রস্টের গলনে কি ফিরে আসবে দূর অতীতের মারণ জীবাণু!

পার্মাফ্রস্ট গলে গেলে অতীত যুগের বিপজ্জনক রোগজীবাণু আবার ফিরে আসতে পারে। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এমন সম্ভবনা প্রবল।

২০১৬ সালের গরমকালে সাইবেরিয়ার ইয়ামাল উপদ্বীপে হঠাৎ করে অ্যানথ্রাক্স রোগ ছড়িয়ে পড়ে। তাতে একটি কিশোর ও ২০০০-এরও বেশি বল্গা হরিণ মারা যায়, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রায় ২০ জন মানুষ। পরে জানা যায়, এই সংক্রমণ ঘটেছিলো একটা বল্গা হরিণের লাশ থেকে। সেই লাশটা অন্তত একশ বছরের পুরোনো। এতোদিন সেটা পার্মাফ্রস্টের নিচে চাপা পড়েছিলো। পার্মাফ্রস্টের গলনে সেটা বাইরে বেরিয়ে আসে।

কিছু দিন আগে নরওয়ের স্পিটসবার্গেন এলাকার কয়েকটা জায়গায় একদল বিজ্ঞানী কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেসব জায়গায় পার্মাফ্রস্টের প্রতি গ্রাম হিমায়িত মিশ্রণে তারা ১০ লাখ থেকে ১ কোটি পর্যন্ত জীবাণু পেয়েছিলেন। এগুলোর মধ্য প্রায় এক চতুর্থাংশ ডিফ্রস্টিং-এর পরেও বেঁচে ছিলো। ২০১৪ সালে সাইবেরিয়ায় পার্মাফ্রস্টের নিচ থেকে মিলিভাইরাস ও পিথোভাইরাস নামক দুটো ‘অতিকায়’ ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। এই ভাইরাস দুটোও ডিফ্রস্টিং-এর পরে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিলো।

বিজ্ঞান বলছে, এমন অনেক জীবাণু ও ভাইরাস আছে যারা সুদীর্ঘকাল বরফের মধ্যে জমে থাকার পরেও নষ্ট হয় না। অনুকূল পরিবেশ পেলে তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো আবার প্যাথোজেন বা রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু। বর্তমানে পার্মাফ্রস্টের গলন যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে অতীত কালের এধরনের নানান রোগজীবাণু আবার ফিরে আসার সম্ভবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

শেষের কথা

পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়াটা কোনো দিক থেকেই মানুষের পক্ষে শুভ লক্ষণ নয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এটা একটা মস্তো বড়ো কুফল। অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নির্গমনের কারণে যেভাবে এই উষ্ণায়ন ঘটে চলেছে, তাতে আমাদের এখনি সাবধান হওয়া দরকার। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]