প্রবাল প্রাচীর: সাগর জলের বিচিত্র প্রাণ

বিস্ময়কর প্রবাল প্রাচীর

এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে কতোই না বিস্ময়কর বস্তু। সমুদ্র গর্ভের প্রবাল প্রাচীর এমনই এক বিস্ময় বস্তু। সুন্দর রঙের মহিমায় খুব সহজেই মানুষের মন জয় করে নিতে পারে প্রবাল। হঠাৎ দেখলে একে জড়বস্তু মনে হতে পারে, আসলে কিন্তু প্রবাল জীবন্ত সামুদ্রিক প্রাণী। এদের সাথেই প্রবাল প্রাচীরে বাস করে আরো অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী। অসাধারণ প্রাণবৈচিত্রের জন্য এই প্রাচীরগুলো অতুলনীয়।

প্রবাল ও তার প্রাচীর

বিস্ময়কর সামুদ্রিক জীব প্রবাল (Coral)। এরা প্রাণী, কিন্তু চলেফিরে বেড়ায় না। বরং সাগরতলে এক জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। প্রাণীজগতে এদের স্থান অ্যান্থোজোয়া শ্রেণীতে। এরা অমেরুদন্ডী। প্রবালের অনেকগুলো প্রজাতি আছে।

এক একটা প্রবাল-প্রাণীকে বলা হয় পলিপ। এই পলিপগুলো সাধারণত আকারে খুবই ছোটো, মাত্র ১/২ মিলিমিটার লম্বা। জিনগত ভাবে সম্পর্কিত এরকম হাজার হাজার প্রবাল-পলিপ সমুদ্রের নিচে কলোনি বানিয়ে একসাথে বাস করে। এই কলোনি থেকেই গড়ে ওঠে প্রবাল প্রাচীর।

প্রবালের পলিপ নিজের দেহের ওপর ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে এক বিশেষ খোলস তৈরি করে। একই কলোনির হাজার হাজার পলিপের খোলস পরস্পর জুড়ে গিয়ে ক্রমশ একটা বড়ো কাঠামো গড়ে ওঠে। সেই কাঠামোর ওপরে— প্রবাল-পলিপরা মারা যাওয়ার পর— বেড়ে ওঠে নতুন পলিপদের কলোনি। এই ভাবে শত শত বছর ধরে একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে সমুদ্রের নিচে রূপ নেয় প্রবাল প্রাচীর (Coral Reef)।

প্রবাল প্রাচীরগুলো দেখতে অপূর্ব সুন্দর। এগুলো বাদামি, লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, সোনালি, ইত্যাদি নানান রঙে রঙানো থাকে। একই প্রাচীরের আলাদা আলাদা অংশ আলাদা আলাদা আকারের হতে পারে, যেমন, হরিণের শিং, মৌমাছির চাক, মানুষের মস্তিষ্ক, ইত্যাদি। প্রবাল প্রাচীরের মূল উপাদান প্রবাল-ক্ষরিত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। এছাড়াও প্রাচীরে বসবাসকারী অ্যালজি, স্পঞ্জ ও অন্যান্য জীবরা এতে নানান উপাদান যোগ করে এর বর্ণবৈচিত্রকে আরো বাড়িয়ে তোলে।

রঙবাহারি প্রবাল প্রাচীর

প্রবালের জীবন কাহিনী

প্রাণী হিসেবে প্রবাল একেবারে অনন্য। এদের খাওয়াদাওয়া থেকে বংশবৃদ্ধি, সব কিছুই অদ্ভুত। প্রবালের পলিপগুলো তাদের টেন্টাকেল বা আকর্ষের সাহায্যে সাগরের জলে ভেসে আসা অতিক্ষুদ্র প্রাণী-প্ল্যাঙ্কটন শিকার করে খায়। সাধারণত রাতের বেলায় এরা এইভাবে শিকার ধরে। তবে এইভাবে পলিপগুলো তাদের পুষ্টি চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ করে। এদের পুষ্টির বেশিরভাগটা আসে এদের দেহকলায় আশ্রয় নেওয়া অতিসূক্ষ্ম অ্যালজিদের কাছ থেকে। প্রবাল-বান্ধব এই মিথোজীবী অ্যালজি জ়োঅক্স্যানথেলাই (Zooxanthellae) নামে পরিচিত।

জ়োঅক্স্যানথেলাই অ্যালজিদের সাথে প্রবালের বন্ধুত্ব অতি ঘনিষ্ঠ। অ্যালজিরা প্রবালের থেকে পায় নিশ্চিন্ত আশ্রয় আর কার্বন ডাইঅক্সাইড। এই কার্বন থেকে তারা সূর্যের আলোয় খাবার তৈরি করে। তৈরি খাবারের ভাগ পায় প্রবাল। এছাড়াও প্রবাল সাগরের জল থেকে অজৈব ক্যালসিয়াম, নাইট্রোজন, ফসফরাস, ইত্যাদি শোষণ করে কাজে লাগাতে পারে।

অযৌন ও যৌন, দুরকম পদ্ধতিতেই প্রবাল বংশবৃদ্ধি করে। যৌন জননের ক্ষেত্রে অন্তঃনিষেকবহিঃনিষেক, দুই-ই হয়ে থাকে। বহিঃনিষেকের জন্য প্রবালের পছন্দ বসন্তকাল। এই সময় পূর্ণিমা থেকে পরপর ক’দিন, জোছনা রাতে সাগরজলের মায়াবী পরিবেশে প্রবাল প্রাচীরের পলিপরা ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ছড়িয়ে যৌন জননে মেতে ওঠে। ডিম্বাণু ও শুক্রাণুগুলোর মিলনে জন্ম নেয় নতুন নতুন পলিপ।

প্রবাল প্রাচীর নানা রঙে রঙীন। রঙগুলোর একটা উৎস প্রবাল-বান্ধব অ্যালজি। এই অ্যালজিদের থেকে প্রবাল পায় বাদামি থেকে সোনালি-বাদামি রঙ। এছাড়াও প্রবাল-পলিপের দেহে থাকা কিছু বিশেষ প্রোটিনের কারণেও প্রাচীরে উজ্জল লাল, সবুজ, নীল, ইত্যাদি রঙ তৈরি হয়।

কয়েকটা বিশ্ব বিখ্যাত প্রবাল প্রাচীর

গ্রীষ্মমন্ডলীয় সমুদ্রের অগভীর তলদেশে সাধারণত প্রবাল প্রাচীর দেখতে পাওয়া যায়। তবে গভীর সমুদ্রে বা নাতিশীতোষ্ণ ও শীতপ্রধান অঞ্চলের সমুদ্রেও কিছু প্রবাল প্রাচীর আছে। সাগর মহাসাগরের পরিষ্কার তরঙ্গোচ্ছল জল প্রবালের পক্ষে অনুকূল। পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা ধরণের প্রবাল প্রাচীর রয়েছে। যেমন—

  • উপকূলীয় প্রবাল প্রাচীর,
  • ব্যারিয়ার প্রবাল প্রাচীর,
  • অ্যাটল জাতীয় প্রবাল প্রাচীর,
  • প্ল্যাটফর্ম প্রবাল প্রাচীর,
  • ব্যাঙ্ক প্রবাল প্রাচীর,
  • প্যাচ প্রবাল প্রাচীর,
  • রিবন প্রবাল প্রাচীর, ইত্যাদি।

সমুদ্রের বুকে প্রবাল প্রাচীরগুলো খুব ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়। একটা গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রাচীর এক বছরে মাত্র ১ থেকে ৩ সেন্টিমিটার ছড়ায়। প্রবাল প্রাচীর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বাড়তে বাড়তে একসময় ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে দ্বীপে পরিণত হয়েছে, এমন উদাহরণও কম নেই। এগুলোকে বলা হয় প্রবাল দ্বীপ

পৃথিবীর বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর হলো অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড উপকূলের কাছে অবস্থিত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। এটা ২৯০০টা ক্ষুদ্রতর প্রাচীর ও ৯০০টার মতো প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত এক বিরাট কাঠামো যা প্রায় ২৬০০ কিমি লম্বা। মহাকাশ-স্টেশন থেকে পৃথিবীর যে কয়েকটা প্রাণী-সৃষ্ট কাঠামো খালি চোখে দেখা যায় তার মধ্যে একটা হলো গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ।

মেসোআমেরিকান ব্যারিয়ার রিফ হলো পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবাল প্রচীর। ১০০০ কিমি লম্বা এই প্রবাল প্রাচীর মধ্য আমেরিকার উপকূলীয় সমুদ্রে কানকুন থেকে হন্ডুরাস পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম পাপুয়া রাজ্যের উপকূলে রাজা আমপাত সারা পৃথিবীর মধ্যে জীববৈচিত্রে সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রবাল প্রাচীর। এশিয়ার আর একটা বিখ্যাত প্রবাল প্রাচীর হলো লোহিত সাগরীয় প্রাচীর। এটা সমুদ্রের শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রার বড়ো পরিবর্তন সহ্য করার ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত।

ভারতের কচ্ছ ও মান্নার উপসাগরে কয়েকটা বড়ো প্রবাল প্রাচীর আছে। এছাড়া লক্ষদ্বীপ এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে কিছু প্রাচীর দেখতে পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরে প্রবাল প্রাচীরের সংখ্যা কম। তার মধ্যে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ একটা উল্লেখযোগ্য প্রবাল দ্বীপ।

প্রবাল প্রাচীরের গুরুত্ব

সমুদ্রগর্ভের প্রবাল প্রাচীরগুলো আমাদের অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। সব জায়গাতেই এগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে স্কুবা ডাইভিং ও পর্যটনের জনপ্রিয় কেন্দ্র। আকর্ষণীয় রঙের জন্য অলংকার শিল্পে প্রবাল ব্যবহার করা হয়। আমরা যে বস্তুটা পলা নামে চিনি, সেটা আসলে প্রবাল প্রাচীরের টুকরো। এছাড়া প্রবাল প্রাচীরগুলোর আশেপাশে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে, প্রবাল থেকে অ্যালঝাইমার্স, ক্যানসার, ইত্যাদি দুরারোগ্য রোগের ওষুধ তৈরি করা সম্ভব।

তবে প্রবাল প্রাচীরের গুরুত্বকে কেবল অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে বিচার করলে ভুল হবে। কারণ, এগুলোর রয়েছে অসাধারণ প্রাকৃতিক গুরুত্ব। অগভীর সমুদ্রের প্রবাল প্রাচীরগুলো ঢেউ ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত থেকে উপকূলীয় ভূমিকে বাঁচাতে বিরাট ভূমিকা নেয়। এগুলো জীববৈচিত্রের জন্যও অতুলনীয়। সমুদ্রতলের মাত্র .১ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকা প্রবাল প্রাচীরগুলো সমস্ত সামুদ্রিক প্রজাতির প্রায় ২৫ শতাংশকে আশ্রয় দেয়।

প্রবাল প্রাচীরকে খাদ্য সংগ্রহ, আশ্রয় ও প্রজননের জায়গা হিসেবে ব্যবহার ক’রে বেঁচে থাকে অন্তত ৪০০০ প্রজাতির মাছ। এছাড়াও এর ওপর নির্ভর করে জীবন কাটায় অ্যালজি, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন, জুপ্ল্যাঙ্কটন, চিংড়ি, কাঁকড়া, মোলাস্ক, লবস্টার, ওয়র্ম, সি অ্যানিমোন, স্টারফিশ, স্কুইড, অক্টোপাস, স্পঞ্জ, ম্যানাটি, ডুগং, ডলফিন, কচ্ছপ, সাপ, ইত্যাদি অসংখ্য সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণী। অতুলনীয় প্রাণবৈচিত্রের জন্য প্রবাল প্রাচীরকে বলা হয় ‘সমুদ্রের বৃষ্টিবন’

প্রাণবৈচিত্রে ভরা প্রবাল প্রাচীর

প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা প্রবাল প্রাচীর

প্রবাল প্রাচীরের সংকট

ফসিল রেকর্ডের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে, আজ থেকে ৪৮,০০,০০,০০০ বছর আগে সমুদ্রে প্রবালের আবির্ভাব ঘটেছিলো। এক একটা প্রবাল প্রাচীর পরিণত রূপ নিতে হাজার হাজার বছর সময় লেগে যায়। আধুনিক প্রবাল প্রাচীরগুলোর বেশির ভাগই অন্তত ১০,০০০ বছর পুরোনো। এতো দিন এগুলো ভালোভাবে বিকশিত হলেও আজ এদের সামনে এসেছে দুর্দিন।

এযুগে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে সমুদ্রের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে সমুদ্রজলের আম্লিকতা। [আরো পড়ুন ➤ জ্বলন্ত সমস্যা বিশ্ব উষ্ণায়ন | প্রতিকার ভাবনা] এটা প্রবালের জন্য বিপদ। তাছাড়া কলকারখানার বর্জ্য ও প্লাস্টিক আবর্জনা থেকে আজকাল বহু জায়গায় সমুদ্র দূষণ ঘটছে। সমুদ্রতীরে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সানস্ক্রিনের রাসায়নিক থেকেও সমুদ্রের জল কলুষিত হচ্ছে। এগুলো সবই প্রবালের মারাত্মক ক্ষতি করছে।

উপকূলের ম্যানগ্রোভ বনগুলো ধ্বংস হওয়াতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রবাল প্রাচীরের ওপর। কারণ, এগুলো ছিলো প্রবাল সাগরের অনেক জৈব পুষ্টি-উপাদানের উৎস।  এরপর মানুষের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত প্রবাল সংগ্রহের সমস্যা তো আছেই। প্রবাল সাগরে লাগামছাড়া মাছ শিকার আর একটা বড়ো সমস্যা। প্রায়শই মাছ মারতে বিষ বা বিস্ফোরকও ব্যবহার করতেও পেছপা হচ্ছে না বেপরোয়া মানুষ।

সম্প্রতি কয়েকটা অধ্যয়ন থেকে জানা গেছে, গত ৩০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর মানব সৃষ্ট কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। হিসেব করে দেখা গেছে, এভাবে চললে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৯০ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।

অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা প্রয়োজন

সমুদ্রের পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে পড়ায় ইদানিং কালে বহু জায়গায় প্রবাল প্রাচীর সাদা হয়ে যাচ্ছে। এটাকে বলা হচ্ছে প্রবালের রঙ হারানো বা কোরাল ব্লিচিং। কোরাল ব্লিচিং-এর ফলে ক্রমশ মরে যাচ্ছে প্রবাল প্রাচীরের প্রবাল, একই সাথে বিপন্ন হয়ে পড়ছে এর ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের একটা বড়ো অংশ কোরাল ব্লিচিং-এর ফলে এর মধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে।

আজকাল কোথাও কোথাও মৃতপ্রায় প্রবালকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সংরক্ষণের সুবিধার জন্য কোথাও কোথাও প্রবাল প্রাচীরকে নানা রকম ট্যাগ দেওয়া হয়েছে, যেমন, বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ, ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট, মেরিন পার্ক, ইত্যাদি। অনেক দেশে আইন করে প্রবাল প্রাচীরকে সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। তবে কেবল আইন করে কি আর প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচানো সম্ভব? সংকটের মূল কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সমুদ্র দূষণে রাশ টানতে না পারলে বিপন্ন প্রবাল প্রাচীরগুলোকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। [ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]